নতুন কমান্ডারের নেতৃত্বে আফ্রিকায় তৎপরতা বাড়াচ্ছে ভাগনার
ফিলিস্তিনের গাজায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলছে রক্তপাত। বিশ্ববাসীর বেশির ভাগেরই নজর এখন সেদিকে। এরই মাঝে আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারকে কাজে লাগিয়ে ২০১৮ সাল থেকে আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায় নিজেদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে মস্কো। তবে বড় ধাক্কা আসে গত বছর। এ বছর ভাগনারের বিদ্রোহ এবং বাহিনীটির প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর আফ্রিকায় তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে।
রাশিয়ায় বেশ কয়েকটি ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে ভাগনারের মতো ক্রেমলিনের কাছাকাছি কোনোটি যেতে পারেনি। ভাগনারের যোদ্ধাদের মতো অন্য কোনো ভাড়াটে বাহিনীর যোদ্ধাদেরও এত ব্যাপকভাবে মোতায়েন করা হয়নি। ভাগনারের মাধ্যমে লিবিয়া ও আফ্রিকায় অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রেখেছে মস্কো। এতে ক্রেমলিনের খুব বেশি খরচও হয়নি।
এ কারণেই হয়তো বিদ্রোহের পরও ভাগনারকে কখনোই পুরোপুরি ভেঙে দেয়নি ক্রেমলিন। সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাহিনীটিকে ভেঙে দেওয়ার বদলে প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর তাঁর বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থগুলো রাশিয়ার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর বিদেশে অবস্থান করা ভাগনার যোদ্ধাদের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউকে। বলতে গেলে এ দায়িত্ব পেয়েছেন রুশ জেনারেল আন্দ্রেই আভেরিয়ানভ। ইউক্রেনে এখন ভাগনারের যোদ্ধারা লড়াই করছেন ‘ভলান্টিয়ার কোরের’ অধীনে। অন্য দেশগুলোতে তাঁদের বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘এক্সপিডিশনারি কোর’।
লাভজনক আফ্রিকা
খনিজ সম্পদ ও জ্বালানির দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ মহাদেশগুলোর একটি আফ্রিকা। এই মহাদেশে লিবিয়ার সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল ও সোনার মজুত রয়েছে। এ ছাড়া ভৌগোলিক দিক দিয়ে দেশটির সঙ্গে নাইজার, চাদ, সুদান ও ইউরোপের সংযোগ রয়েছে। এতে করে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ লিবিয়া।
ভাগনারের দায়িত্ব পাওয়ার পর আফ্রিকা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেনারেল আন্দ্রেই আভেরিয়ানভ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মালি, বুরকিনা ফাসো, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও নাইজার সফরের পর লিবিয়ায় গিয়ে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রধান ফিল্ড মার্শাল খলিফা হাফতারের সঙ্গে দেখা করেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি যে প্রস্তাবটা দিয়েছেন, তা হলো নিরাপত্তার বিনিময়ে সম্পদ।
সংঘাতে জর্জরিত লিবিয়ায় পূর্ব ও পশ্চিমে—দুটি আলাদা পার্লামেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় পার্লামেন্টের অধীনে রয়েছে হাফতারের বাহিনী। এর বিপরীতে রাজধানী ত্রিপোলিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সরকার রয়েছে। এই সরকারের অধীনে রাশিয়ার বেশ কিছু তেল উত্তোলনকেন্দ্র রয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, এর অর্থ হলো নিজ অঞ্চলে ‘এক্সপিডিশনারি কোরের’ যোদ্ধাদের মোতায়েনের জন্য হাফতার ও তাঁর মিত্রদের অর্থ খরচ করতে হবে।
ইউরোপভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের গবেষক তারেক মেগেরিসির ভাষ্যমতে, ‘ভাগনারকে (বর্তমানে এক্সপিডিশনারি কোর) হাফতারের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি যখন ভাগনারকে লিবিয়ায় মোতায়েন করছেন, তখন এই বাহিনী সেখান থেকে সিরিয়া ও সুদানসহ অন্যত্র অভিযান চালাতে পারবে।’
তারেক মেগেরিসি বলেন, এটি একটি নেটওয়ার্ক। ভাগনার শুধু সামরিক সহায়তাই দিচ্ছে না, লিবিয়াকে ব্যবহার করে অবৈধ মাদক ও সোনা চোরাচালানও করছে।
এমনকি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ও বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী পাচারের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে। ভাগনারের জন্য লিবিয়া একটি বিরাট লাভজনক এলাকা।
লিবিয়ায় ভাগনার
বর্তমানে লিবিয়ায় ‘এক্সপিডিশনারি কোরের’ আনুমানিক ৮০০ যোদ্ধা মোতায়েন রয়েছেন। এ ছাড়া আফ্রিকার সাব-সাহারা এলাকায় বাহিনীটির আরও প্রায় ৪ হাজার ৬০০ যোদ্ধা রয়েছেন। লিবিয়ায় এই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তিনটি বিমানঘাঁটিও রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করে সুদানসহ সাব-সাহারার অন্যান্য অঞ্চল থেকে মিত্রদের কাছ থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করে হাফতার ও ‘এক্সপিডিশনারি কোর’।
এর পাশাপাশি লিবিয়ার তবরুক বন্দরে রুশ যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর বিনিময়ে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বৈমানিকদের প্রশিক্ষণ দেবে মস্কো।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির ইভান ক্লিসজকজ বলেন, ভূমধ্যসাগরের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল ইউরোপ ও ন্যাটোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। ইতিমধ্যে এ সাগরে সিরিয়ার তারতোউস বন্দরে রাশিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। এরপর আবার তবরুক বন্দরে রুশ যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের অনুমতি দেওয়া হলে এ অঞ্চলে রাশিয়ার উপস্থিতি আরও জোরদার হবে। ফলে এ অঞ্চলে ইউরোপের সঙ্গে মস্কোর প্রতিযোগিতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শেষ খেলা
তবে লিবিয়ার যুদ্ধের ময়দানে ভাগনার কিন্তু একা নয়। ত্রিপলি–সমর্থিত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ও তুরস্কের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিও সেখানে রয়েছে। ২০২০ সালে হাফতার যখন রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তখন তাঁকে সমর্থন দেওয়া ভাগনার যোদ্ধাদের বিতাড়িত করেছিলেন ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ও তুরস্কের বাহিনীর সদস্যরাই।
এ ছাড়া লিবিয়ার জ্বালানি খাতে মস্কোর যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে, তার নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ত্রিপলির তুর্কি মিত্ররা। এমন পরিস্থিতিতে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন–পরবর্তী সংকটের মধ্যে যে অনাস্থার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তার শিকার যে হাফতারের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক হবে না, সে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
ইভান ক্লিসজকজ বলেন, রাশিয়া যে হাফতারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। মস্কোর কাছে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর অবস্থানের কারণে। একজন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর গুরুত্ব নেই। একই কথা তুরস্কের বেলায়ও খাটে। ভাড়াটে যোদ্ধারা যে তুরস্কের সঙ্গে হাত মেলাবে না, সেটাও ধরে নেওয়া যায় না। বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলে তারা এমনটা করেছে।
ইভান ক্লিসজকজের মতে, ‘আপনার এটা মাথায় রাখতে হবে যে আঞ্চলিক প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করেই একটি বৈশ্বিক কৌশল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে রাশিয়া। পুতিনের উদ্দেশ্য হলো ভারত ও চীনকে নিয়ে একটি বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা। বর্তমানে শুধু পশ্চিমাদের নিয়ে যেমন বিশ্বব্যবস্থা, তেমনটি নয়।’