যে কারণে ইমরানের পতন
পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটে হেরে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন ইমরান খান।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতা ইমরানের পতনের পেছনের কারণ কী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বিবিসির পাকিস্তান প্রতিনিধি সেকেন্দার কারমানি।
২০১৮ সালে ইমরান পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সে সময় প্রায় সবকিছুই তাঁর পক্ষে ছিল বলে মনে হয়েছিল।
বিশ্বজয়ী ক্রিকেটার হিসেবে ইমরান তাঁর দেশে জাতীয় নায়ক বনে যান। পরে তিনি নিজেকে একজন ‘ক্যারিশমাটিক’ রাজনীতিবিদে রূপান্তরিত করেন।
রাজনৈতিক সাফল্য পেতে বছরের পর বছর ধরে ইমরান লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি সফল হন। পাকিস্তানে কয়েক দশক ধরে আধিপত্য বিস্তারকারী দুটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলকে হটিয়ে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন।
ইমরানের দল পিটিআই পাকিস্তানে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে পিটিআইয়ের সমাবেশগুলো জনতায় পরিপূর্ণ থাকতে দেখা যায়। পাশাপাশি দেখা যায়, সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সরব উপস্থিতি। এসবের মাধ্যমে তিনি তাঁর দৃঢ় দুর্নীতিবিরোধী বার্তার বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন।
ইমরান অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি তাঁর দেশে পরিবর্তন আনবেন। একটি নতুন পাকিস্তান গড়বেন।
পাকিস্তানে কোনো প্রধানমন্ত্রীই কখনো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তবে ইমরানকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি সম্ভবত তা পারবেন।
যেসব কারণের আলোকে ইমরানের অবস্থান সুরক্ষিত মনে হয়েছিল, সেই একই কারণ তাঁর পতন ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ইমরান ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে কথিত আছে। তবে উভয় পক্ষই এ কথা অস্বীকার করে। এখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরানের সেই সম্পর্ক চুকে গেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
নিঃসন্দেহে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানের উল্লেখযোগ্য ও বাস্তবিক জনসমর্থন ছিল। কিন্তু পাকিস্তানে যাকে ‘স্টাবলিশমেন্ট’ বলা হয়, সেই সেনাবাহিনীর দিকে থেকেও নির্বাচনে তাঁর প্রতি গোপন সমর্থন ছিল।
ইমরানের শাসনামলে দেশটির সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাই সমালোচকেরা ইমরানের সরকারকে একটি ‘হাইব্রিড শাসনামল’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করে ইমরানের দলত্যাগী এক সদস্য বিবিসিকে বলেছেন, ‘তিনি (ইমরান) তাদের (সেনাবাহিনী) দ্বারাই তৈরি। তারাই তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিল।’
ইমরানের প্রধান প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফ। তাঁকে প্রথমে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। পরে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অনেকের সন্দেহ, নওয়াজ অতীতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে নওয়াজের শাস্তির আসল কারণ ছিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ।
ক্ষমতায় আসার পর ইমরান গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি ও সেনাবাহিনী একই মতাদর্শের অধিকারী।
ইমরানের এমন ঘোষণা নাগরিক সমাজের কর্মীদের উদ্বিগ্ন করে। ইমরানের শাসনামলে তাঁর সরকার ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই—উভয়ের সমালোচনাকারী সাংবাদিক-ভাষ্যকারেরা হামলা-অপহরণের শিকার হন। ইমরানের সরকার ও সেনাবাহিনী উভয়ে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে। কিন্তু কোনো অপরাধীকে কখনোই শনাক্ত করেনি ইমরান সরকার।
ইমরানের সরকার পাকিস্তানে সুশাসনের উন্নতির বিষয়ে জোর দিয়েছিল। সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে দারুণ কিছু কাজ করেছেন ইমরান। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের একটা বড় অংশে স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প চালুর কথা বলা যায়।
তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে ইমরান হোঁচট খান। যেমন দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য রাজনৈতিক নবাগতকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাঁর এ সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে সমালোচনা ও উপহাস কুড়ায়।
ইমরানের আরও অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। তাঁর শাসনামলে পাকিস্তানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়েছে। ডলারের বিপরীতে পতন ঘটেছে পাকিস্তানি রুপি।
ইমরানের সমর্থকেরা এ পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক অবস্থাকে দায়ী করেন। কিন্তু এ কথা সত্য, পাকিস্তানে ইমরানের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়ছিল।
একসময় ইমরানের বিরোধীরা সেনাবাহিনীর বিরোধিতায় ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা এমনকি সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের নাম ধরে ধরে বলতেন, কে কে ইমরানকে ক্ষমতায় এনেছেন।
কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গত বছর। বেশ কয়েকজন পর্যবেক্ষক বিবিসিকে বলেছেন, সুশাসন দিতে ইমরানের ব্যর্থতা, বিশেষ করে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি দেশটির সেনাবাহিনীকে ক্রমশ হতাশ করে। ইমরানকে ক্ষমতায় আনার জন্য তাঁর বিরোধীরা যেভাবে জনসমক্ষে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করে আসছিল, সম্ভবত তা থেকেও বের হতে চাইছিল ‘স্টাবলিশমেন্ট’।
ইমরানের পতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করেছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ও আইএসআইয়ের প্রধান লে. জেনারেল ফাইজ হামিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। ফাইজ পরবর্তী সেনাপ্রধান হতে আগ্রহী ছিলেন বলে ব্যাপকভাবে কথিত ছিল।
হামিদ স্পষ্টতই তাঁর সেনাপ্রধান হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। ফাইজ প্রতিবেশী আফগানিস্তানের কর্মকর্তাদের আগেই বলেছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, হামিদকে এমন একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, যিনি নোংরা কাজগুলো কার্যকরভাবে করতে পারতেন। যেমন রাজনীতিবিদদের বশে আনা কিংবা সমালোচকদের মুখ বন্ধ করা। কিন্তু তাঁকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়নি।
বাজওয়া ও ফাইজের মধ্যকার বিরোধ গত অক্টোবরে তীব্র আকার ধারণ করে। এর বিরোধী ইমরানও জড়ান। বাজওয়া আইএসআইয়ের প্রধান হিসেবে নতুন একজনকে চাইছিলেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ফাইজের সঙ্গে ইমরান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি দৃশ্যত আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত তাঁকে দায়িত্বে রাখতে চেয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল, ফাইজ আবার ইমরানের বিজয় নিশ্চিতে সাহায্য করতে পারেন।
পাকিস্তানের নিয়ম অনুযায়ী, সেনাপ্রধানের পরামর্শ মেনে আইএসআইয়ের প্রধান পদে নিয়োগ দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আইএসআইয়ের প্রধান পদে সেনাপ্রধানের পছন্দের ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দিতে ইমরান বিলম্ব করছিলেন। সেনাবাহিনী ও ইমরান সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের এ দৃশ্যমান ফাটল বিরোধীদের উৎসাহিত করে।
বিরোধীরা যখন অনাস্থা ভোটের পরিকল্পনা শুরু করে, ইমরানের দল ও জোটের মিত্রদের থেকে সাংসদদের সম্ভাব্য পক্ষত্যাগের বিষয়ে বলতে থাকে, তখন বেশ কয়েকটি সূত্র বিবিসিকে বলে, সামরিক বাহিনী বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা এবার ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিতে যাচ্ছে।
ইমরানের দলের একজন পক্ষত্যাগী সদস্য বিবিসিকে বলেছেন, ফাইজ আইএসআইয়ের প্রধান থাকাকালে তিনি ও অন্য সাংসদেরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাটির কাছ থেকে ফোন পেতেন। তাঁদের কী করতে হবে, সে বিষয়ে গোয়েন্দা নির্দেশনা দিতেন। তাঁদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হতো। আইএসআইয়ের প্রধান পদ থেকে ফাইজকে সরিয়ে দেওয়ার পর এ ধরনের ফোনকল বন্ধ হয়। এখন আর সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করছে না।
তবে পাকিস্তানি সাংবাদিক কামরান ইউসুফ বিবিসিকে বলেন, সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ইমরানের মিত্রদের ‘ম্যানেজ’ করার সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত ছিল। সেনাবাহিনীর এ সমর্থন হারালে ইমরানের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ইমরান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আরও বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়, বিশেষ করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। ইউক্রেন আগ্রাসনের জেরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে নিন্দায় অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ইমরান। অন্যদিকে সেনাপ্রধান বাজওয়া গত সপ্তাহে বলেন, ইউক্রেনে রুশ হামলা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। ভারত ইস্যুতেও ইমরানের সঙ্গে বাজওয়ার বিরোধ তৈরি হয়েছিল।
ইমরান বারবার অভিযোগ করে আসছেন, পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের (যুক্তরাষ্ট্র) নেতৃত্বাধীন ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। কারণ হিসেবে তিনি তাঁর সরকারের পশ্চিমাবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির কথা বলেন। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষক এ অভিযোগকে ‘অতিরঞ্জন’ বলে নাকচ করেন।
বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে