পাকিস্তানে গুমের ঘটনায় মোশাররফসহ সরকারপ্রধানদের নোটিশ দেওয়া হবে: আদালত
‘বলপূর্বক গুমসংক্রান্ত নীতির প্রতি অঘোষিত মৌন সম্মতি দেওয়ায়’ পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফ, ইমরান খানসহ পরবর্তী সব নির্বাহী প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে নোটিশ প্রদানে সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। গতকাল রোববার ইসলামাবাদ হাইকোর্ট এ আদেশ দেন। খবর ডনের।
ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ রোববার ১৫ পৃষ্ঠার এ আদেশ দেন। সাংবাদিক মুদাসসর মাহমুদ নারো ও আরও পাঁচ ব্যক্তির গুমের ঘটনাসংক্রান্ত মামলায় তাঁদের আবেদন চূড়ান্ত যুক্তিতর্কের জন্য ধার্য করে এ আদেশ দেওয়া হয়। তবে শুনানি মুলতবির আবেদন করেছে সরকারপক্ষ।
আদেশে বিচারপতি মিনাল্লাহ বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও উত্তরসূরি সব নির্বাহী প্রধান এবং বর্তমান দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রীরা বলপূর্বক গুমসংক্রান্ত নীতির প্রতি অঘোষিত মৌন সম্মতি দেওয়ার মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এভাবে তাঁরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীকে এ কাজে জড়িত করে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলায় কেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে আদালত আদেশ দেবেন না, তা ব্যাখ্যা করে নিজ নিজ হলফনামা জমা দেবেন।’
বিচারপতি বলেন, পারভেজ মোশাররফ তাঁর আত্মজীবনী ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’-এ অকপটে স্বীকার করেছেন, বলপূর্বক গুম ‘রাষ্ট্রের অঘোষিত নীতি ছিল’।
আদেশে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেন, এই অনুমান খণ্ডন করার দায়িত্ব প্রত্যেক নির্বাহী প্রধানের ওপর। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে কেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা ব্যাখ্যা করাও তাঁদের দায়িত্ব।
আদেশে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য সশস্ত্র বাহিনী ত্যাগ স্বীকার করে আসছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে। সশস্ত্র বাহিনীর এই ত্যাগ প্রত্যেক নাগরিকের সম্মান জানানো উচিত। অন্যথায় দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা এবং এর জনগণ ঝুঁকির মুখে পড়বে।
তবে আদেশে বলা হয়, নাগরিকের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘন হয়, এমন কর্মকাণ্ডে সশস্ত্র বাহিনীর জড়িত থাকা কিংবা জড়িত থাকার ধারণা আইনের শাসনকে দুর্বল ও ক্ষুণ্ন করে।
বিচারপতি মিনাল্লাহ বলেন, যদি গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করা না হয় অথবা কার্যকর ও লক্ষণীয় পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকার গ্রহণ না করে, তাহলে বর্তমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সশরীর আদালতে হাজির হতে হবে। অভিযোগের পর ব্যবস্থা গ্রহণ ও সহানুভূতি প্রদর্শনে অনীহায় আবেদনকারীরা যে অকল্পনীয় যন্ত্রণা ও বেদনাবোধের শিকার হয়েছেন, এ কারণে কেন তাঁদের (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বিরুদ্ধে আবেদন (পিটিশন) গ্রহণ ও তাঁদের ওপর দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হবে না, সে ব্যাখ্যা তাঁদের দিতে হবে।
আদেশে বলা হয়, ভবিষ্যতে গুমের অভিযোগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও সংশ্লিষ্ট প্রদেশের নির্বাহী প্রধানের বিরুদ্ধে কেন ফৌজদারি মামলা গ্রহণের আদেশ দেওয়া হবে না, সে বিষয়ে আদালতকে অ্যাটর্নি জেনারেলের সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে।
মানুষের গুম হওয়ার বিষয়টি ফলাও করে প্রচার না করায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকারও সমালোচনা করেন আদালত। পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, নিখোঁজ লোকজনের পরিবারের অকল্পনীয় কঠিন বাস্তবতা ও যন্ত্রণা তুলে ধরতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমগুলো রাষ্ট্রশক্তির নিপীড়নের এই ভয়াবহ ধরন ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি হয়তো এড়িয়ে যেতে পছন্দ করে অথবা এটাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো বিষয় মনে করছে না।
গুমের ঘটনায় আদালত পার্লামেন্টের ভূমিকায়ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আদালত বলেছেন, পার্লামেন্ট ও সংশ্লিষ্ট প্রদেশের আইনসভা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চূড়ান্ত অঙ্গ। কিন্তু তারা তাদের
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে তা নির্দেশ করে এমন কোনো দাপ্তরিক রেকর্ড নেই।
আদালত পিটিশনের ওপরে শেষবারের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে অ্যাটর্নি জেনারেলকে সুযোগ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘ধার্য দিনে (১৭ জুন) কেন্দ্রীয় সরকার নিখোঁজ ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করবে অথবা বিষয়টি তদন্ত ও তাঁদের অবস্থান চিহ্নিত করার ব্যর্থতার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেবে।’