গিলগিট-বালটিস্তানকে নতুন প্রদেশ ঘোষণা পাকিস্তানের, কেন খেপল ভারত?
ভারতের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও পাকিস্তান তাদের নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তানকে বিশেষ প্রদেশের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আর পাকিস্তানের এ ঘোষণা নয়াদিল্লি মনে করছে, কাশ্মীরের উত্তর সীমান্তঘেঁষা গিলগিট-বালটিস্তানকে জোর করে শাসন করে আসছে ইসলামাবাদ। গত রোববার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গিলগিট-বালটিস্তানে গিয়ে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও নদী বাঁধ নির্মাণসহ একাধিক প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ সময় তিনি গিলগিট-বালটিস্তানকে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রদেশ করার ঘোষণা দেন।
আগেই জানা গিয়েছিল, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা গিলগিট-বালটিস্তানকে বিশেষ প্রদেশের মর্যাদা দিতে চলেছে পাকিস্তান। সেই সিদ্ধান্তের ঘোষণায় গিলগিট-বালটিস্তানে গিয়ে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, নদী বাঁধের মতো একাধিক প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ইমরান।
বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখাওয়া, পাঞ্জাব ও সিন্ধ—পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ।
গিলগিট-বালটিস্তানকে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করার খবরে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত। ভারত বলেছে, চুক্তি ভঙ্গ করেছে পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী গিলগিট-বালটিস্তান ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ এবং এই চুক্তিতে এও স্পষ্ট করা হয়েছে, জোর করে দখল করা এ এলাকার কোনো পরিবর্তনই করার কোনো অধিকার নেই।
গিলগিট-বালটিস্তানের পাশে চীন ও আফগানিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গিলগিট-বালটিস্তানকে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রদেশ ঘোষণাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই গিলগিট-বালটিস্তানকে আলাদা অঞ্চল হিসেবে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। এই অংশের আলাদা মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যের প্রশাসনিক সরকারও রয়েছে। আজাদ কাশ্মীর সীমান্তের এই ভূখণ্ডকে সরাসরি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করলে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশ থেকে অনেক মানুষের যাতায়াত বেড়ে যাবে এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে সেখানে মানুষের আসার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।
গত রোববার ইমরান খান বলেছেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসা গিলগিট-বালটিস্তানকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রদেশের মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ পাকিস্তান সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার গিলগিট-বালটিস্তানের জনগণের একটি দীর্ঘকালীন দাবি।’
আনুষ্ঠানিকভাবে গিলগিট-বালটিস্তানকে পঞ্চম প্রদেশ করতে পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
পুরো কাশ্মীরের ওপর সার্বভৌমত্ব দাবি করা ভারত পাকিস্তানের এ ঘোষণার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটি বলেছে, তারা এ পদক্ষেপকে ‘স্পষ্টতই প্রত্যাখ্যান করে’। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘তথাকথিত গিলগিট-বালটিস্তান’ হলো ভারতের অঞ্চল। এ এলাকাকে প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তানের ঘোষণা এ অঞ্চলে ছদ্মবেশে ‘অবৈধ এবং জোরপূর্বক দখলের’ প্রচেষ্টা।
গিলগিট-বালটিস্তানকে প্রদেশ ঘোষণার পদক্ষেপটি ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ধরে রেখার জন্যই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, ইমরান এমন সময়ে এ ঘোষণা দিলেন, যখন দিন দিন অর্থনীতির অবস্থা করুণ হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতির রেকর্ড গড়েছে পাকিস্তান এবং ক্ষমতাসীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) জনপ্রিয়তাও মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
গিলগিট-বালটিস্তানের শিক্ষার্থী নাভিদ সালেম বলেছেন, ‘ইমরান খান ধাপ্পাবাজি করছেন। এ অস্থায়ী অবস্থা আমরা চাইনি। এ ঘোষণায় গিলগিটকে পাকিস্তানের সাংবিধানিক অংশ হিসেবে গড়ে তুলবে না। আমরা এখনো পাকিস্তানের সরকার গঠনের জন্য ভোট দিতে পারি না। আমরা এখনো পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতে যেতে পারি না। এটা একটা রসিকতা।’
গিলগিট-বালটিস্তানের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ শান মোহাম্মেদ খানও ইমরানের নতুন ঘোষণা আশাবাদী নন। তিনি বলেন, সাংবিধানিক পরিবর্তন ছাড়া ইমরান খানের কথার অর্থ নতুন কিছুই নয়। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন সামনে হওয়ায় তারা কেবল তাদের ভোট ব্যাংক বাড়ানোর জন্যই এ কাজ করছে।
তবে পাকিস্তানের এ পদক্ষেপে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন খুশি হবে। এই অঞ্চলটি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিসি) মধ্যে। সিপিসি পাকিস্তান ও চীনের মধ্য চলমান একটি পরিকাঠামো প্রকল্প। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ বাণিজ্যিক পরিকাঠামো প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে এ এলাকার গুরুত্ব রয়েছে। আর বেইজিং এ এলাকার স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষার দিকেই জোর দিচ্ছে।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়ার সহকারী পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এ ঘোষণা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার উত্তেজনার তাপমাত্রাকে আরও বেশি বাড়িয়ে তুলবে। পাকিস্তান বেশ কিছু দিন ধরেই এ পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। পাকিস্তান-ভারত এবং ভারত-চীন উভয়ের সম্পর্কে এটি গভীর সংকট তৈরি করবে।
গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলটি বৃহত্তর কাশ্মীরের অংশ। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের পর ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত কাশ্মীর নিয়ে লড়াই বাধলে কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে এবং আরেকটি অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। গিলগিট-বালটিস্তান মূল কাশ্মীরের অংশই ছিল।
গত বছর জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করেছিল ভারত। ওই সময় পাকিস্তান এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা গিলগিট-বালটিস্তানকে প্রদেশের মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ভারতকে একটি জবাব দিল পাকিস্তান।
তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান ও দ্য ডিপ্লোম্যাট