ক্ষমতা হারালে ইমরানের রাজনৈতিক জীবন কি শেষ হয়ে যাবে

ইমরান খান একটি জনপ্রিয় ও পাশ্চাত্যবিরোধী ‘আখ্যান’ তৈরির চেষ্টা করছেন। তাঁর অনেক অনুসারী এই আখ্যান বিশ্বাস করছেনছবি: এএফপি

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেশটির পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি। আজ রোববার (৩ এপ্রিল) দেশটির জাতীয় পরিষদে এই অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হতে পারে। এই ভোটে তিনি ক্ষমতা হারাতে পারেন। কারণ, জাতীয় পরিষদে তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে।

অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ইমরান যদি ক্ষমতা হারান, তাহলে কি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বিবিসির পাকিস্তান ও আফগানিস্তান প্রতিনিধি সেকেন্দার কারমানি। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ক্ষমতা হারালেও ইমরানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আশঙ্কা কম।

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের একটি মধ্যবিত্ত এলাকায় নিজের সেলুন আছে ৩২ বছর বয়সী মুজাহিদ আলীর। ইমরান ক্ষমতা হারালে তিনি দুঃখ পাবেন না বলে জানান।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মুজাহিদ পরিতাপের সঙ্গে বলেন, ‘আমি তাঁর (ইমরান) শাসনামল উপভোগ করিনি।’

ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিবিদ বনে গিয়ে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই আসনেই জয়লাভ করেন ইমরান। সেই নির্বাচনে ইমরানকে ভোট দিয়েছিলেন মুজাহিদ।

মুজাহিদ আশা করেছিলেন, নতুন ও তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান ও তাঁর দল পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারবে। কিন্তু মুজাহিদের আশা পূরণ করতে পারেননি ইমরান।

পাকিস্তানে জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধির জন্য ইমরানের পিটিআই দলকে দায়ী করেন মুজাহিদ। তিনি বলেন, ‘আপনি সারা দিন কাজ করে ৫০০ রুপি আয় করলেন। কিন্তু এখন ১ কেজি মাখন কিনতেই ৫০০ রুপি লাগে, যা আগে ছিল ১৮০ রুপি।’

ইমরান ক্ষমতা হারালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন বর্তমান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) নেতা শাহবাজ শরিফ।

শাহবাজের ভাই নওয়াজ শরিফ। তিনি তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগে তিনি ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। নওয়াজ বর্তমানে লন্ডনে আছেন। তিনি শুরু থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। নওয়াজ বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

শাহবাজ শরিফসহ বিরোধী নেতারা
ছবি: এএফপি

শাহবাজের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তিনিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

নওয়াজ-শাহবাজ সম্পর্কে মুজাহিদ বলেন, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারেন, কিন্তু তাঁরা অন্তত দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করেন।

মুজাহিদের সেলুনে চুল কাটানোর অপেক্ষায় ছিলেন ২৭ বছর বয়সী আলী মালিক। তিনি একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তিনিও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানকে ভোট দিয়েছিলেন। তিনি এখনো ইমরানকে সমর্থন করেন।

পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলী মালিক বলেন, ‘আমাদের এই কঠিন সময় সহ্য করতে হবে। ইমরান খান একটি অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের উচিত, তাঁর পাশে দাঁড়ানো।’

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইমরানের একটি কঠোর অবস্থান লক্ষ করা গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে ভোট দেওয়ার জন্য সাংসদদের ঘুষ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। তবে বিরোধীরা ইমরানের এই অভিযোগ অস্বীকার করছে।

নওয়াজ শরিফ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ে প্রায় সব মানুষের কম-বেশি অভিযোগ আছে। এমনকি ইমরানের নিজের নির্বাচনী এলাকার লোকজনও একই অভিযোগ করছেন।

ইসলামাবাদের সেলুনমালিক মুজাহিদ জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেন। হাতের তালু মাথায় আঘাত করতে করতে তিনি বলেন, এই দেশের গরিব মানুষেরা একদম নিঃশেষ হয়ে গেছে।

সেলুনমালিকের মতো আরও কেউ কেউ ইমরানকে ‘অযোগ্য’ হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু বিপরীত চিত্রও রয়েছে। যেমন গৃহিণী ইরাম ও নওরিন ইমরানের যুক্তির পক্ষে। ইমরানের কথা হলো, করোন মহামারির কারণে বিশ্বজুড়েই দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। পাকিস্তানও তার ব্যতিক্রম নয়।

ইরাম ও নওরিনের ভাষ্য, শুধু পাকিস্তান নয়, সারা বিশ্বেই দ্রব্যের দাম বেড়েছে। যদিও ইরাম ও নওরিনের সঙ্গে থাকা আরেক বন্ধু এই বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেন।

তবে সত্য হলো, বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশের তুলনায় পাকিস্তানে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জেরে ইমরানকে ক্ষমতা থেকে হটানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই পদক্ষেপের পেছনে দেশটির ‘এলিট’ গোষ্ঠীর হাত রয়েছে।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া
ফাইল ছবি: এএফপি

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইমরান ক্ষমতায় আসেন বলে ব্যাপকভাবে কথিত রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর ইমরানের পাশে নেই। আর ইমরানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাঁর এই দুর্বল অবস্থায় তাঁকে চরম আঘাতটি করার সুযোগ নিচ্ছে।

ইমরানের জোটের বেশ কিছু অংশীদার পক্ষত্যাগ করেছে। পক্ষত্যাগ করাতে তাদের প্ররোচিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

কয়েকটি দল ইমরান সরকারের জোট ছেড়ে বিরোধী শিবিরে ভেড়ায় পিটিআই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।

ইমরান তাঁর বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইমরান দাবি করেন, তিনি একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার, যারা পাকিস্তানে শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে।

ইমরানের ভাষ্য, মার্কিন কর্মকর্তারা পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সতর্ক করে বলেছেন যে পররাষ্ট্র নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণে তাঁকে (ইমরান) ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে।

ইমরানের পররাষ্ট্র নীতিসংক্রান্ত যেসব সিদ্ধান্ত বাইরের শক্তিকে ক্ষুব্ধ করেছে বলে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক রাশিয়া সফরের কথা বলা যায়। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ইমরান মস্কোয় গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ নিয়ে আগে থেকেই ইমরান বেশ সমালোচনামুখর।

পাকিস্তানের পার্লামেন্ট
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতিকেরা ইমরানের এই অভিযোগকে ‘উপহাস’ করেছেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইমরানের অভিযোগ অস্বীকার করছে। তারা বলছে, ইমরানের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।

ইমরান একটি ‘পপুলিস্ট’ ও পাশ্চাত্যবিরোধী ‘আখ্যান’ তৈরির চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়। তাঁর অনেক উত্সাহী, অনুসারী এই আখ্যান বিশ্বাস করছেন।

যেমন ২৫ বছর বয়সী পাকিস্তানি সোহেল আক্তার। তিনি মার্কেটিংয়ের কাজ করেন। তিনি ২০১৮ সালে ইমরানকে ভোট দিয়েছিলেন। তিনি এখনো ইমরানকে সমর্থন করেন।

সোহেল বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, পাকিস্তান বিশ্বমঞ্চে সম্মানিত হোক। আর সেটাই হয়েছে।’

মোহাম্মদ পাকিস্তানের একজন সরকারি কর্মচারী। তিনি বলেন, ‘দেখুন, তিনি (ইমরান) কীভাবে ইসলামভীতির (ইসলামোফোবিয়া) বিরুদ্ধে কথা বলছেন। অথচ আমরা আগে ক্রীতদাসের মতো ছিলাম।’

পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতিকেরা
ছবি: এএফপি

সম্প্রতি ইমরান গর্বের সঙ্গে ঘোষণা দেন যে তিনি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী একই মতাদর্শের অনুসারী। তাঁর অনেক অনুসারী নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখেন। যাঁরা দৃঢ়ভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেন।

সেনাবাহিনী সম্পর্কে বলতে গিয়ে ২৫ বছর বয়সী পাকিস্তানি শাফকাত স্বীকার করেন, ‘আপনি তাদের (সেনাবাহিনী) সমর্থন ছাড়া সরকার গঠন করতে পারবেন না, এ কথা ঠিক। কিন্তু তিনি (ইমরান) আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন।’

পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরানও সম্ভবত তা পারবেন না।

বিবিসির পাকিস্তান ও আফগানিস্তান প্রতিনিধি সেকেন্দার কারমানির মতে, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিঃসন্দেহে ইমরানের জনপ্রিয়তা হ্রাস করেছে। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে ইমরান একটি বড় শক্তি হিসেবে টিকে থাকবেন বলেই মনে হয়।

বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে