ইমরান খান: চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হননি
একসময় সেনাবাহিনীর ‘বরপুত্র’ মনে করা হতো তাঁকে। সাবেক সেই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবার নিজেকে দেখতে পান প্রান্তিক হিসেবে। জাতীয় নির্বাচনে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয় এবং তাঁর দলও পড়ে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে।
১৯৫২ সালে লাহোরে জন্ম নেওয়া ইমরান খান প্রথম খ্যাতি পান একজন ক্রিকেটার হিসেবে। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের একমাত্র বিশ্বকাপ জয় হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জোর দেন ইমরান খান। ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) গঠন করেন তিনি। তবে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে তেমন সফলতা পাননি। ওই সময় ব্যাপক দুর্নীতি ও বেকারত্ব সংকটে তরুণদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। রাজনৈতিক প্রচারণায় একে কাজে লাগিয়ে তরুণদের কাছে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন ইমরান।
২০১৩ সালের নির্বাচনের পর ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে আন্দোলন শুরু করেন ইমরান খান। সে সময় ইসলামাবাদে মাসব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তিনি। সে সময় পেশোয়ারে আর্মি পাবলিক স্কুলে প্রাণঘাতী হামলা হওয়ার পর ওই কর্মসূচি থেকে সরে আসেন ইমরান।
২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। সে সময় তাঁর জনপ্রিয়তা এত তুঙ্গে ওঠে যে পাকিস্তানের প্রভাবশালী মহলের সমর্থন নিয়ে তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে যাচ্ছেন বলে আলোচনা শুরু হয়। সে সময় জাতীয় নির্বাচনে বিতর্কিত জয়ের পর ইমরান খান জোট সরকার গঠন করেন। ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।
ঐতিহাসিক বিদায় ও দোষারোপ
দেশে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারে এসেছিলেন ইমরান। কিন্তু ক্ষমতায় বসার অল্প দিনের মধ্যেই গুরুতর কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন তিনি। কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কার সঙ্গে নজিরবিহীন মুদ্রাস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতি বাড়তে থাকে। পাশাপাশি নিজের মিত্রদের সঙ্গেও তাঁর মতভিন্নতা দেখা দেয়।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও ইমরানের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ২০২১ সালের অক্টোবরে নতুন গোয়েন্দা প্রধান নিয়োগ নিয়ে ইমরান নেতৃত্বাধীন সরকার ও সেনা নেতৃত্বের মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠন করে। বছর দেড়েকের মাথায় এই পিডিএম পার্লামেন্টে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব তোলে। দলীয় কিছু নেতা বিরোধী শিবিরে হাত মেলালে ওই ভোটে হেরে যান তিনি। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত ১২টা ছোঁয়ার পরপরই ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ হয়ে যায়।
তখন ইমরান তাঁর দলের নেতাদের জাতীয় পরিষদ থেকে পদত্যাগের নির্দেশনা দেন। পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার প্রাদেশিক সরকারও বিলুপ্তির ঘোষণা দেন তিনি। ক্ষমতাসীন পিডিএম সরকারকে আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য করার জন্য তিনি এসব পদক্ষেপ নিলেও সেগুলো কোনো ফল দেয়নি।
ক্রমেই হতাশাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে থাকা ইমরান খান তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অভিযুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের মাসগুলোতে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন তিনি। সে সময় অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির অভিযোগে তোশাখানা মামলাসহ কয়েকটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলে।
ইমরান খান ২০২২ সালের অক্টোবরে হাকেকি আজাদির (সত্যিকার স্বাধীনতা) জন্য ইসলামাবাদ অভিমুখে লংমার্চ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আনজুমের কঠোর সমালোচনা এবং অন্য দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবি করে তিনি ওই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
ওই বছর ৩ নভেম্বর পিটিআইয়ের লংমার্চের বহর ওয়াজিরাবাদে পৌঁছালে ইমরান খানকে হত্যার চেষ্টা হয়। পায়ে বেশ কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর। তখন লংমার্চ বন্ধ করে ঘোষণা করেন ইমরান। রক্তপাত এড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান তিনি।
২০২৩ সালেও সাবেক সেনাপ্রধান বাজওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন ইমরান। তিনি দাবি করেন, তাঁর জীবন নাশের চেষ্টার পেছনে রয়েছেন তখনো চাকরিতে থাকা একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। বাজওয়ার হয়ে এ কাজ করেন তিনি। বাজওয়াকে ‘অতি ক্ষমতাশালী’ ব্যক্তি আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বাজওয়াই দায়ী।
গ্রেপ্তার, দণ্ড ও অযোগ্য ঘোষণা
২০২২ সালের ৯ মে আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইসলামাবাদ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর কাছে ‘কালো অধ্যায়’ তকমা পাওয়া ওই বিক্ষোভ-সহিংসতা দুই দিন ধরে চলে। ক্ষুব্ধ পিটিআই সমর্থকেরা রাস্তায় বেরিয়ে বিভিন্ন সেনা স্থাপনায়ও হামলা চালান। সেনাবাহিনীর লাহোর কোর কমান্ডারের বাসভবনেও হামলা হয়।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীও দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। পরবর্তী কয়েক দিন পিটিআইয়ের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাঁদের কেউ কেউ এখনো জেলে আছেন। তখন ইমরান খান সুপ্রিম কোর্টের আদেশে জামিনে মুক্তি পেলেও তাঁর দলের ওপর চাপ অব্যাহত থাকে।
এরপর গত বছর ৫ আগস্ট তোশাখানা মামলায় ইমরানকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত এবং তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন তাঁকে পাঁচ বছর নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে। তাঁর পিটিআই চেয়ারম্যানের পদও বাতিল হয়।
ইসলামাবাদ হাইকোর্ট পরে তোশাখানা মামলায় দণ্ড স্থগিত করলেও ইমরান খান অন্য মামলায় কারাবন্দী আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সাইফার মামলাসহ অনেকগুলো মামলা চলছে। সাইফার মামলায় ইমরান ও পিটিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মেহমুদ কুরেশির বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ইমরান খান। কিন্তু তোশাখানা মামলায় দণ্ডের কারণে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলে ইমরানের পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরাই সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। আজ ঘোষিত ২৬৩ আসনের চূড়ান্ত ফলে ১০১টিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাঁদের ৯ জন বাদে সবাই পিটিআই সমর্থিত। নির্বাচনে ৭৫ আসনে জয় পেয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং ৫৪ আসনে জয় পেয়েছে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। এই দুই দল মিলে জোট সরকার গঠনের আলোচনা চলছে। তাদের এই চেষ্টা সফল হলে পিটিআই নেতারা সরকার গঠন করতে পারবেন না। কিন্তু ইমরান খানের প্রতি ভোটারদের এই রায় পাকিস্তানের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।