ফিরে দেখা ২০২৪
পাকিস্তানে ‘নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা’ আর ‘বুশরা–চমকের’ বছর
দেখতে দেখতে আরেকটি বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন, মূল্যস্ফীতি আর যুদ্ধের বছর ছিল ২০২৪। এ বছর বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিশেষ বিশেষ ঘটনা নিয়ে পাঠকদের জন্য আমাদের বিশেষ আয়োজন।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকার একটি আসনের প্রার্থী শেহরিয়ার আফ্রিদিকে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয় বোতল। স্থানীয় পশতু ভাষায় কাউকে বোতল বা ‘খালি কলসি’ বলার মানে হলো ওই ব্যক্তি নীরস ও বোকাসোকা ধরনের। রাজধানী ইসলামাবাদের একটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আমির মুঘলকে দেওয়া হয় বেগুন প্রতীক। পাঞ্জাব প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় একটি আসন থেকে লড়া ইজাজ গাদ্দান পান বিছানা প্রতীক। এসব প্রতীক বরাদ্দের মাধ্যমে প্রার্থীদের হেনস্তা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ইজাজ বলেন, ‘এটা কোনো নির্বাচন নয়, এটা নিষ্ঠুরতা!’
২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের ফল অনেকটা আগেই নির্ধারিত ছিল। তাই নির্বাচনের নামে এটা যে ‘নিষ্ঠুর রসিকতা’ ছিল, ইজাজ গাদ্দানের এ দাবির সঙ্গে দ্বিমত করা কঠিন। এসব প্রতীক বরাদ্দ পাওয়া প্রার্থীদের মূল পরিচয়, তাঁরা দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির নেতা। নির্বাচন কমিশন দলীয় প্রতীক কেড়ে নিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েন তাঁরা। কিন্তু এরপরও এমন হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল তাঁদের।
এই নির্বাচন ও সরকার গঠন থেকে ইমরান খান ও তাঁর দল পিটিআইকে সরিয়ে রাখতে এমন কোনো কৌশল ছিল না, যা সেনা–সমর্থিত রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেনি। শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে লড়েন পিটিআইয়ের প্রার্থীরা। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সবচেয়ে বেশি আসন পান তাঁরা। কিন্তু ছোট আরও কয়েকটি দল নিয়ে সরকার গঠন করে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। আর এই পুরো আয়োজনে ছিল দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর পক্ষ সামরিক বাহিনী।
পিএমএল-এন, পিপিপি ও সামরিক বাহিনীর জোট
ভুট্টো আর শরিফদের পারিবারিক রাজনীতির ধারার বাইরে নতুন রাজনীতির পথ দেখান ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খান। ‘নয়া পাকিস্তানের’ স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৮ সালের আগস্টে হন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। দুই পরিবার আর জেনারেলদের বাইরে ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন ধারা তৈরি করেন। যদিও সমালোচনা রয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন তিনি।
তবে পাকিস্তানের ক্ষমতাচক্রের মূল খেলোয়াড় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরানের সম্পর্ক বেশিদিন টেকসই হয়নি। ২০২২ সালের এপ্রিলে জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের আনা অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান। কোনো রাখঢাক ছাড়াই পিটিআই প্রতিষ্ঠাতার অভিযোগ, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর আয়োজনে ছিল সামরিক বাহিনী। ২০২৩ সালের ৯ মে ইমরানকে গ্রেপ্তারের জেরে হামলা হয় রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায়। এর পর থেকে দৃশ্যত মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায় পিটিআই আর সামরিক বাহিনী।
ইমরানকে হটানোর পর বাকি মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করেছিল পিএমএল-এন ও পিপিপি জোট। এরপর নানা নাটকীয়তার পর ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। এই নির্বাচন থেকে ইমরান খান ও তাঁর দলকে বিরত রাখতে এককাট্টা হয় প্রতিদ্বন্দ্বী পিএমএল-এন ও পিপিপি এবং সামরিক বাহিনী।
গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার
নির্বাচন কমিশন থেকে আদালত—রাষ্ট্রীয় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, যা ইমরান ও তাঁর দলকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে ব্যবহার করা হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরানের বিরুদ্ধে ১৮০টির বেশি মামলা হয়। নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি মামলায় ইমরানকে সাজা দেওয়া হয়। ইমরানসহ দলের শীর্ষ নেতাদের অনেককে কারাগারে পাঠানো হয়। সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে পিটিআইয়ের কিছু নেতা নতুন দল গঠন করেন। নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় একাংশ।
সাজার কারণে নিজ দলের প্রধানের পদে অযোগ্য হন ইমরান। পরে দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে পিটিআই নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করে। কিন্তু পিটিআইয়ের গঠনতন্ত্র ও নির্বাচন কমিশনের আইন (ইসিপি) মেনে নির্বাচন হয়নি—এমন অভিযোগ এনে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর দলটির ‘ব্যাট’ প্রতীক বাতিল করে ইসিপি। এরপর ১৩ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। বাধ্য হয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে লড়েন পিটিআইয়ের প্রার্থীরা। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ঠুনকো কারণ দেখিয়ে একের পর এক পিটিআই প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। পুলিশের দমন-পীড়নের কারণে প্রচারণাও চালাতে পারেননি অনেক প্রার্থী।
লড়াকু পিটিআইয়ের বিস্ময়কর ফল
সব ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নির্বাচনের মাঠে ছিল পিটিআই। নজিরবিহীন কারচুপির পরও অভাবনীয় ফল করে ইমরানের দল। জাতীয় পরিষদের ২৬৬ আসনের মধ্যে ২৬৫ আসনে ভোট হয়। এতে কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। জাতীয় পরিষদে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯২, নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন ৭৫ আর বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পিপিপি ৫৪ আসন পেয়েছে। বাকি আসন পেয়েছে অন্য দলগুলো।
নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়। ভোট শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও আনুষ্ঠানিকভাবে অর্ধেক আসনের ফলও দিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। মূলত সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের এমন ফলাফলে ধাক্কা খায় ইমরানবিরোধী জোট। অভিযোগ উঠেছিল, ফলাফল কারচুপি করতে নেওয়া হয় সময়ক্ষেপণের এই কৌশল।
করাচি শহরের প্রাদেশিক পরিষদের পিএস-১২৯ আসনে জামায়াতে ইসলামির প্রার্থী হাফিজ নাইম উর রেহমানকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। পরে তিনি বলেন, পিটিআই–সমর্থিত প্রার্থী সাইফ বারি তাঁর চেয়ে ভোট বেশি পেয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আসন কমাতে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে তিনি আসনটি ছেড়ে দেন।
একক দল হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও শেষ পর্যন্ত সরকার গঠন করতে পারেনি পিটিআই। ক্ষমতা ভাগাভাগি করে ছোট কয়েকটি দল নিয়ে সরকার গঠন করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা পিএমএল-এন ও পিপিপি। সমঝোতা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী হন পিএমএল-এনের শাহবাজ শরিফ আর প্রেসিডেন্ট হন পিপিপির আসিফ আলী জারদারি।
বছরের শেষ ‘বুশরা–চমক’
খেলার মাঠের লড়াকু মানসিকতা রাজনীতির মাঠেও ধরে রেখেছেন ইমরান খান। কারাগারে থেকেই পিএমএল-এন, পিপিপি ও সামরিক বাহিনীর জোটের বিরুদ্ধে অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ লড়াইয়ে জামায়াতে ইসলামিসহ কয়েকটি দলের সমর্থনও পেয়েছেন তিনি। একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে নির্বাচনের পর থেকেই ক্ষমতাসীন জোটকে চাপে রেখেছেন তিনি। ন্যূনতম লক্ষ্য রাজনৈতিক সমঝোতা।
৯ মাস সাজা ভোগ করে বছরের শেষ দিকে কারাগার থেকে মুক্তি পান ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি। বছর শেষে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেন তিনি। ইমরান খানের মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগ দাবি এবং বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা সংসদকে দিয়ে আনা সংবিধান সংশোধনের প্রতিবাদে গত ২৪ নভেম্বর ইসলামাবাদের ডি-চকে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় পিটিআই। এ কর্মসূচিকে ‘চূড়ান্ত ডাক’ অভিহিত করেন ইমরান খান। এ কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় এসেছেন বুশরা বিবি।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে গাড়িবহর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীরা। নিকাব পরে গাড়িবহরেই ছিলেন বুশরা বিবিও। ইমরানকে মুক্ত না করে ডি-চক থেকে ফিরবেন না বলে অঙ্গীকার করেন তিনি। পথে পথে আবেগঘন ও জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে নেতা-কর্মীদের চাঙা করে তোলেন বুশরা। কর্মসূচি ঘিরে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। সমাবেশে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে পিটিআই নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত সাতজন নিহত হন। কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পিটিআইয়ের সমাবেশ ঘিরে অবরুদ্ধ হয় পড়েছিল রাজধানী ইসলামাবাদ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা’ দিয়ে সেনা মোতায়েন করা হয়। আগে থেকেই জারি ছিল ১৪৪ ধারা। কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত ২৬ নভেম্বর রাতে ডি-চকে ঢুকে পড়েন পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীরা। পরদিন ভোরে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীদের হটিয়ে দেয়। ‘রক্তপাত’ এড়াতে ওই দিন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা জানায় পিটিআই নেতৃত্ব।
তবে এখনই থামছেন না ইমরান খান। দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ২৫ নভেম্বর ও গত বছরের ৯ মের সহিংসতার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে ৫ ডিসেম্বর তাঁর অফিশিয়াল এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, ‘এ দুই দাবি যদি পূরণ না হয়, তাহলে ১৪ ডিসেম্বর অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে। আর এর যেকোনো পরিণতির জন্য দায়ী থাকবে সরকার।’ অবশ্য পরে সরকারের সঙ্গে সংলাপের স্বার্থে পিটিআই এ কর্মসূচি স্থগিত করে। পিটিআইয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ।
এদিকে গত বছরের ৯ মের সহিংসতার ঘটনায় ২১ ডিসেম্বর সামরিক আদালত পিটিআইয়ের ২৫ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন। সামরিক আদালতে ইমরান নিজেও বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে ২০২৪ সালে সামরিক বাহিনীর ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী হামলা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক দুর্দশায় জর্জরিত পাকিস্তানের সামনে আরও একটি টালমাটাল বছর অপেক্ষা করছে বলেই মনে হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: এএফপি, ডন ও জিও নিউজ