ইমরানের ‘নয়া পাকিস্তানে’ ফিরছেন পুরোনোরা
আরেকটি জাতীয় নির্বাচন ঘিরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এবারের নির্বাচন গতবারের মতো নয়। বিগত নির্বাচনে ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা ইমরান খান এখন কারাবন্দী। ভোটের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁর কাছে ক্ষমতা হারানো নওয়াজ শরিফ। তাঁকে ক্ষমতায় আনতে নেপথ্যে থেকে সেনাবাহিনী কলকাঠি নাড়ছে বলে অভিযোগ তুলেছে ইমরানের দল।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাজনীতিতে দুই পরিবারের (ভুট্টো–শরিফ) নিয়ন্ত্রণ ভেঙে জয় ছিনিয়ে আনে ইমরানের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই)। ‘কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে’ তাঁর ‘নয়া পাকিস্তান’ স্লোগান তরুণদের সমর্থন পেয়েছিল বলে মনে করা হয়। অবশ্য ওই সময় ইমরান সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদ পেয়েছেন বলেও প্রচার আছে।
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণের কথা রয়েছে। নিজ শহর মিনওয়ালিসহ দুই আসনে কারাগার থেকেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ইমরান খান। রাষ্ট্রীয় উপহার কেনাবেচা (তোশাখানা) মামলায় নিম্ন আদালতে তিন বছরের সাজা হয়েছিল ইমরান খানের। তবে উচ্চ আদালত সেই রায় স্থগিত করেন। তাঁর সাজা স্থগিত নাকি বহাল থাকবে, নির্বাচনের আগেই বিষয়টি সুরাহা হতে পারে। ফলে তাঁর নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত।
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিরোধে ইমরানের দল এখন বিপর্যস্ত। তাঁর সঙ্গে কারাগারে রয়েছেন দলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শাহ মাহমুদ কুরেশি। এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ বেশ কয়েকজন নেতাও কারাবন্দী। কয়েকজন নেতা পিটিআইয়ের রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। দমন–পীড়ন এড়াতে কেউ কেউ রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মামলায় বিপর্যস্ত কারাবন্দী ইমরান নিজেও দলীয় প্রধানের পদ ছেড়েছেন। পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান হয়েছেন গহর আলী খান। তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে পিটিআই। তবে এ নির্বাচনে ইমরানের দলের দৌড় যে অংশগ্রহণেই সীমাবদ্ধ থাকছে, তা অনেকটাই নিশ্চিত। কারণ, তাঁর ক্ষমতায় ফেরা ঠেকাতে রাজনৈতিক মাঠ থেকে প্রশাসন—সর্বত্র সব আয়োজন সম্পন্ন বলা চলে।
মোড় ঘোরানো এক বিক্ষোভ
জাতীয় পরিষদে আনা আলোচিত এক অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গত বছরের এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান। এক কূটনৈতিক তারবার্তার বরাত দিয়ে তাঁর অভিযোগ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। এ কাজে সায় ছিল সামরিক বাহিনীর।
এরপর সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্রমশ সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে ইমরানের। বিভিন্ন সভা–সমাবেশে সামরিক কর্মকর্তাদের সরাসরি আক্রমণ করে বক্তব্য দিতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন আসিম মুনির। ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁকে কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ আছে ইমরানের বিরুদ্ধে।
প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো ইমরানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। এর মধ্যে তোশাখানা, তারাবার্তা ফাঁস ও আল–কাদির ট্রাস্ট মামলা উল্লেখযোগ্য। মামলায় হাজিরা দিতে গেলে ৯ মে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর নজিরবিহীন এক সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানজুড়ে। দেশটির সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা মনে করা হয় সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরকে, যেটি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স (জিএইচকিউ) নামে পরিচিত। ইমরান খানের দলের কর্মী ও সমর্থকেরা সেই সেনা সদর দপ্তরে ঢুকে সেনাবাহিনীর পতাকাসংবলিত সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছিলেন।
লাহোরে সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলের বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়। বাড়ির আসবাব ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার সময় সেই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে দেখা যায় ইমরানের সমর্থকদের। যদিও ইমরানকে ওই যাত্রায় বেশি দিন কারাগারে থাকতে হয়নি।
পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনী বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এ ঘটনাকে পাকিস্তানের ইতিহাসে ‘কালো দিন’ বলে অভিহিত করেন সেনাপ্রধান আসিম মুনির। এরপর ইমরান খানকে সরাতে তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই একই পদ্ধতির আশ্রয় নেন ক্ষুব্ধ জেনারেলরা। দুর্নীতির মামলা ও সাজার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর স্পষ্ট বার্তা, ইমরান ‘চূড়ান্ত সীমা’ অতিক্রম করেছেন।
তোশাখানা মামলায় ইমরান খানের তিন বছরের সাজার দিন গত ৫ আগস্ট তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এবার আর সহিংস বিক্ষোভ দেখাননি ইমরানের সমর্থকেরা। পরে উচ্চ আদালত তাঁর এ সাজা স্থগিত করেন। কিন্তু তারবার্তা ফাঁসের মামলায় কারাগারে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। কারা চত্বরে দ্রুতগতিতে এ মামলার শুনানি চলছে।
দৃশ্যত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিরোধে পাকিস্তানের রাজনীতির পুরোনো ঘেরাটোপেই আটকা পড়েছেন পারিবারিক রাজনীতির বাইরে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করা ইমরান। পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন কাপ্তানের রাজনৈতিক ইনিংস আর বেশি দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণই বলা চলে।
নওয়াজের প্রত্যাবর্তন
প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিরোধে গিয়ে ইমরানের পরিণতিই হয়েছিল নওয়াজ শরিফের। ‘উন্নত চিকিৎসার’ জন্য ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডন গিয়েছিলেন তিনি। দৃশ্যত সমঝোতার অংশ হিসেবে তখন কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি।
ইমরানকে হটানোর চকে বড় ভূমিকা ছিল নওয়াজের। বিশেষ করে রাজনৈতিক জোট গঠনে। শেষ পর্যন্ত ইমরানকে হটিয়ে ছোট ভাই শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে বিরোধীরা জোট সরকার গঠন করে। এর পর থেকে নওয়াজের দেশে ফেরার গুঞ্জন শুরু হয়।
সাধারণ নির্বাচনের লক্ষ্যে গত ৯ আগস্ট জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অবসান ঘটে। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে পরে গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি হবে ভোট গ্রহণ।
গত ২১ অক্টোবর দেশে ফেরেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সর্বোচ্চ নেতা নওয়াজ শরিফ। দেশে ফিরেই একের পর এক মামলা থেকে খালাস পেতে থাকেন তিনি। মনে করা হচ্ছে, সবকিছুই হচ্ছে সমঝোতার অংশ হিসেবে।
খোদ নওয়াজের একসময়কার জোটসঙ্গী পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতাদের অভিযোগ, নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী করার সব আয়োজন করছে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন। তিনি যে আরেকবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, ব্যতিক্রমী কিছু না ঘটলে তা অনেকটাই নিশ্চিত।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে বরাবরের মতোই নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে দেশটির গণমাধ্যমে ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ হিসেবে পরিচিত সেনাবাহিনী। আরেকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে গেছেন নওয়াজও। কেবল পুরোনো খেলার বলী হতে যাচ্ছেন ‘নয়া পাকিস্তানের’ স্বপ্ন দেখানো ইমরান খান।