যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কসহ শাহবাজের সামনে এখন কী চ্যালেঞ্জ
পাকিস্তানের সরকারপ্রধানের পদে আবারও ফিরেছেন শাহবাজ শরিফ। গতকাল রোববার দেশটির ২৪তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রেসিডেন্ট শাহবাজ। তিনি দেশটির একমাত্র রাজনীতিক, যিনি পরপর দুই মেয়াদে দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন।
এর আগে সংক্ষিপ্ত শাসনামলে একজন দায়িত্বশীল সরকারপ্রধান হিসেবে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন শাহবাজ। এমনকি এবারের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেও দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে তাঁর নাম সবার সামনে এসেছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগের পর ২০২২ সালের আগস্টে পাকিস্তানের সরকারপ্রধান হন শাহবাজ। ওই সময় তিনি জোট সরকারের নেতৃত্ব দেন। এর আগে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন শাহবাজ।
শাহবাজ দীর্ঘদিন ধরেই একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে পরিচিত। আগের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মোটাদাগে তাঁর দুটি সাফল্য ছিল। এক. একটি ভঙ্গুর রাজনৈতিক জোটের সরকারকে টিকিয়ে রাখা। দুই. ২০২৩ সালের শেষ ভাগে এসে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থ ছাড়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো।
এবারের নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ধারণা করেছিলেন, শাহবাজের বড় ভাই ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ চতুর্থবারের মতো সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেবেন। কোনো দল এককভাবে সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও জোট সরকার গড়ার প্রেক্ষাপটে নওয়াজ জানান, তিনি নন শাহবাজ হবেন প্রধানমন্ত্রী পদে দলের প্রার্থী।
গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পাকিস্তান আবারও ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পেয়েছে। নওয়াজ-শাহবাজের দল পিএমএল-এন, বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তানসহ (এমকিউএম-পি) ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য জোট গড়েছে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন
পাঞ্জাবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শাহবাজ। তিন মেয়াদে এই দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় চার দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তাঁর।
শাহবাজ লাহোরের একটি সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। ওই সময় শাহবাজ লাহোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট হন।
এরপর ১৯৮৮ সালের সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন শাহবাজ। ওই বছরের নির্বাচনে জিতে পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন তিনি। যদিও বেশি দিন এই পদে থাকতে পারেননি তিনি। ১৯৯০ সালে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়।
একই বছর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশ নেন শাহবাজ। জয়ী হয়ে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের সদস্য (এমপি) হন। তবে ১৯৯৩ সালে আবারও তিনি পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে ফিরে আসেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৯৭ সালে শাহবাজ তৃতীয়বারের মতো পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জয় পান। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয় তাঁর। কিন্তু সামরিক বাহিনী পিএমএল-এন সরকারকে উৎখাত করলে শাহবাজকে আটক করা হয়। আট বছরের জন্য কারাগারে পাঠানো হয় তাঁকে।
নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ২০০৮ সালের আবারও পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে ফেরেন শাহবাজ। দ্বিতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। এবার পূর্ণ মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনে জিতে আবারও এই পদে বসেন শাহবাজ।
২০১৮ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে কেন্দ্রের রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হন শাহবাজ। জয় পেয়ে জাতীয় পরিষদের আসেন। দায়িত্ব নেন বিরোধী নেতার।
পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ইমরান খানের বিদায়ে কপাল খুলে শাহবাজের। অচলাবস্থা কাটাতে বিরোধীরা পাকিস্তান ডেমোক্র্যাট অ্যালায়েন্স (পিডিএম) নামে জোট গড়ে। এই জোটের নেতা হিসেবে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ।
শাহবাজের সফলতা
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংক্ষিপ্ত সময়ে শাহবাজের বড় সাফল্য আইএমএফের অর্থ ছাড়ে চুক্তিতে পৌঁছানো। এ অর্জন পাকিস্তানকে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক জোটের ঐক্য ধরে রাখতে তিনি কার্যত সফল হয়েছেন।
যদিও শাহবাজের আমলে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ৩৮ শতাংশ ছুঁয়ে যায়। রেকর্ড অবনমন ঘটে রুপির। বলা হয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীল রাখতে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের কারণে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে দেশটি। পাকিস্তানে অর্থনৈতিক দুরবস্থার পেছনে ইমরান খানের শাসনামলকে দায়ী করেছেন শাহবাজ।
আগামীর চ্যালেঞ্জ
এখনো অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তান। দেশটিতে এখনো মূল্যস্ফীতি আকাশছোঁয়া—৩০ শতাংশের আশপাশে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ—প্রায় ২ শতাংশের কাছাকাছি নেমেছে।
স্বল্প মেয়াদে আইএমএফের অর্থ ছাড় করা এবং দেশের অর্থনীতির গতি ফেরাতে সংস্থাটির সঙ্গে নতুন চুক্তি করা এখন শাহবাজের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
এ ছাড়া আরও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজকে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা পিআইএসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া এবং বিদেশি বিনিয়োগের সুরক্ষা দেওয়া অন্যতম। এসব উদ্যোগ পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট কমানোর চাবিকাঠি হতে পারে।
পাকিস্তানের শরিফ ভাইদের সঙ্গে সৌদি আরবের ক্ষমতাসীন রাজপরিবার ও কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এসব সম্পর্ক বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ টেনে আনতে ভূমিকা রাখতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—দুই গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী তিন দেশ—ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে অম্লমধুর কূটনৈতিক সম্পর্ক গতিশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে।