কেন ইমরান খানের দল ছাড়ছেন নেতারা
ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ইমরান খানকে আধা সামরিক বাহিনীর ধরে নিয়ে যাওয়া, এর জেরে দেশজুড়ে বিক্ষোভ আর সহিংসতার পর তাঁর দল পিটিআই থেকে একের পর এক নেতা পদত্যাগ করছেন। হঠাৎ কেন নেতারা ইমরানের দল ছাড়ছেন, সে প্রশ্ন উঠেছে।
৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করার পর গত কয়েক দিনে যে দুই ডজন পিটিআই নেতা পদত্যাগ করেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন শিরিন মাজারি। গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন তিনি। সাবেক মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রী শিরিনের পদত্যাগের খবর দলটির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে।
ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী সহিংসতার জেরে ১২ মে গ্রেপ্তার হন শিরিন মাজারি। এরপরও একাধিকবার আটক হওয়ার পর পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।
মঙ্গলবার ইসলামাবাদে নিজের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে পিটিআই থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ৫৭ বছর বয়সী শিরিন মাজারি। একই সঙ্গে রাজনীতি আর করবেন না বলেও জানান তিনি। ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর সহিংসতা ও সামরিক স্থাপনায় হামলারও নিন্দা জানান তিনি।
সক্রিয় রাজনীতি ছাড়ার কারণ হিসেবে শিরিন মাজারি বলেন, ‘আমাকে বারবার আটক করা হচ্ছে, আবার ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে আমার মেয়ে ইমান জয়নবকে নির্মম এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এ ছাড়া আমার স্বাস্থ্যগত সমস্যা তো আছে। আমি আর রাজনীতি করব না।’
শিরিন মাজারিসহ অনেক নেতা পিটিআই ছাড়ার পর দলীয় প্রধান ইমরান খান দাবি করেন, তাঁর দলের নেতাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি টুইটে লিখেছেন, ‘আমরা পাকিস্তানে জোরপূর্বক বিয়ের কথা জানতাম কিন্তু পিটিআইতে নতুন এক বিষয় আবির্ভূত হয়েছে—জোরপূর্বক বিচ্ছেদ।’
ইমরান খানের দাবি, পিটিআই নেতারা পদত্যাগ করছেন না, তাঁদের দলত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ধরনের একটি অপকৌশলের মাধ্যমে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে ভেঙে দেওয়া যায় না।
ইমরান খানের নামে শতাধিক মামলা রয়েছে। একবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে জামিন পান। আবার গ্রেপ্তার হতে পারেন—কয়েক দিন ধরে এ আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন ৭০ বছর বয়সী ইমরান। এসবের মধ্যেই পিটিআই নেতাদের একের পর এক দলত্যাগের ঘটনা ঘটছে।
বুধবার ইসলামাবাদে এক আদালতে সাংবাদিকদের ইমরান খান বলেন, তাঁর দলের নেতাদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হচ্ছে। দল ছেড়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা কারও নামও বলে যাচ্ছেন না। তিনি বলেন, লোকজন (পিটিআই নেতারা) পদত্যাগ করছেন না, তাঁদের দলত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ধরনের একটি অপকৌশলের মাধ্যমে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে ভেঙে দেওয়া যায় না।
সেনাবাহিনী পিটিআইকে সব দিক থেকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েক দিনে চাপে পড়ে পিটিআইয়ের অনেক নেতা পদত্যাগ করলেও শিরিন মাজারির মতো তাঁরা প্রভাবশালী ছিলেন না।মাইকেল কুগেলম্যান, ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ
ইমরান খানের অন্যতম উপদেষ্টা শিবলী ফারাজ আল–জাজিরাকে বলেছেন, কিছু ভালো মানুষ দল ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে এটাকে একই সঙ্গে ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।
একের পর এক নেতার পদত্যাগে আসন্ন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন ফারাজ। তিনি বলেন, ইমরান খান দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।
ইমরান খানের ওই উপদেষ্টার দাবি, দেশে এখন যা কিছু হচ্ছে, সবটাই নির্বাচন বানচালের জন্য করা হচ্ছে। কারণ, সরকারের ভয় নির্বাচন হলেই পিটিআই জয়ী হবে। নির্বাচনের দাবি তুলে তিনি বলেন, যদি গণতান্ত্রিক সমাজ হয়, তাহলে কে সরকারে থাকবে, সে সিদ্ধান্ত জনগণকে নিতে দিন।
অভিযোগের তির সেনাবাহিনীর দিকে
পাকিস্তানে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর অতি প্রভাবের সঙ্গে পিটিআই নেতাদের এভাবে দলত্যাগ করার সম্পর্ক দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। তাঁরা বলছেন, পাকিস্তানে দলত্যাগ–দলবদল নতুন কোনো ঘটনা নয়। আর এসব ঘটনা ঘটে থাকে দেশটির সেনাবাহিনীর তৎপরতার মাধ্যমেই।
আগামী দিনগুলোয় পিটিআইয়ের আরও অনেক নেতা পদত্যাগ করবেন বলে ধারণা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হাসান আসকারির। তিনি বলন, এটা (পিটিআই নেতাদের পদত্যাগ) ইমরান খানকে একঘরে করে ফেলার প্রক্রিয়ার একটা অংশ। একই সঙ্গে ইমরান খানকে এটা বুঝিয়ে দেওয়া যে কেউ সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদে জড়ালে পাকিস্তানে রাজনীতিতে তাঁকে ওপরে উঠতে দেওয়া হবে না।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের প্রভাষক সামিন মহসিন আলী বললেন, সাধারণত, পাকিস্তানে রাজনীতিতে আদর্শ নয়, সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই রাজনীতিকদের টিকে থাকতে হয়।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান শিরিন মাজারির পদত্যাগ ইমরান খানের দলের জন্য বড় ধাক্কা বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পিটিআইকে সব দিক থেকেই কোণঠাসা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় চাপে পড়ে পিটিআইয়ের অনেক নেতা পদত্যাগ করলেও শিরিন মাজারির মতো তাঁরা প্রভাবশালী ছিলেন না।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের প্রভাষক সামিন মহসিন আলী বলেন, সাধারণত পাকিস্তানে রাজনীতিতে আদর্শ নয়, সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই রাজনীতিকদের টিকে থাকতে হয়। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাজনীতিটাই এমন। রাজনীতিকদের দলের অবস্থান নয়, বরং নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক গতিবিধি ও উত্থান–পতন এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনার ওপর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাঁরা কখন কোন পক্ষে থাকবেন। এ জন্যই আমরা দেখতে পাই যে জাতীয় বা প্রাদেশিক সরকারে জয়ী হওয়ার ভালো সুযোগ দেখেই রাজনীতিকেরা দল বদলান।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বেনজির শাহ বলেন, যেসব পিটিআই নেতা পদত্যাগ করেছেন, তাঁদের অনেকেই বিদ্বেষ ও ঘৃণার বিষাক্ত রাজনীতির জন্য পরিচিত। তাঁদের রাজনীতি করার বিষয়টি নিয়ে জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব রাজনীতিককে দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন তিনি।
বেনজির শাহ বলেন, রাজনীতি থেকে এসব রাজনীতিককে সরিয়ে দেওয়ার অধিকার ও সুযোগ জনগণের হাতে থাকা উচিত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তাঁদের দলত্যাগের এই সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর দিক থেকে এসেছে। তারাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন দল নির্বাচন করতে পারবে আর কোন দল পারবে না।
এটা (পিটিআই নেতাদের পদত্যাগ) ইমরান খানকে একঘরে করে ফেলার প্রক্রিয়ার একটা অংশ। একই সঙ্গে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া যে কেউ যদি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদে জড়ায়, তাহলে পাকিস্তানে রাজনীতিতে তাঁকে ওপরে উঠতে দেওয়া হবে না।হাসান আসকারি, পাকিস্তানের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
তবে নেতাদের এই দলত্যাগ পিটিআইয়ে কেমন প্রভাব ফেলবে, তা এখন ধারণা করা মুশকিল বলেই মনে করছেন বেনজির শাহ। তিনি বলেন, অতীতেও সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দল ভাঙার চেষ্টা করেছে। যেমন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ–নওয়াজ (পিএমএলএন)।
তবে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে দল হিসেবে পিটিআইয়ের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্টের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসমা ফয়েজ। তিনি বলেন, এই নেতাদের দলত্যাগ পরবর্তী নির্বাচনে পিটিআইয়ের ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলবে। কোনো সন্দেহ নেই যে ইমরান খানের ব্যাপক জনসমর্থন আছে। তবে শক্ত প্রার্থী দরকার, যাঁরা নিজেদের ভোটব্যাংকও দলে টানবেন।