পাকিস্তানে নির্বাচনে মূল খেলোয়াড় কারা
পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন আগামীকাল বৃহস্পতিবার। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা, টানাপোড়েন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে কারাবন্দী, আদালত প্রাঙ্গণে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতাদের ছোটাছুটি—এমন নানা বিষয় আলোচনায় রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো সমান সুবিধা (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) পায়নি।
পাকিস্তানের এবারের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে মূল খেলোয়াড় কারা, দেখে নেওয়া যাক
নওয়াজ শরিফ
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। ‘পাঞ্জাবের সিংহ’ নামেও পরিচিত তিনি। নওয়াজের নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবারের নির্বাচনে প্রয়োজনীয় আসনে জয় পেয়ে এককভাবে কিংবা ক্ষমতাসীন জোটের অধীনে আবারও ক্ষমতায় যেতে চাইছে। এর মধ্য দিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে চান নওয়াজ।
এর আগে নওয়াজ কখনোই পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারেননি। দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে তাঁকে পদ ছাড়তে হয়েছে। একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে, কিংবা নির্বাসনে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়েছে।
৭৪ বছর বয়সী নওয়াজ পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ ধনী। বংশপরম্পরায় তিনি ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। সেই সঙ্গে ইস্পাত ব্যবসা ও কয়েক দশক ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় তাঁর সম্পদ ও প্রভাব বেড়েছে।
প্রায়ই অভিজাত ও দামি ব্র্যান্ড গুচির স্কার্ফ পরতে দেখা যায় নওয়াজকে। অথচ সেটা পরেই তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে নিজেকে ‘মাটির মানুষ’ বলে দাবি করেন। সমর্থকদের কাছে প্রশংসিত হন।
নওয়াজ আর্থিকভাবে রক্ষণশীল, মুক্তবাজার ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের জন্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচিত। আঞ্চলিক রাজনীতিতে চিরশত্রু ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বরাবর আগ্রহ দেখিয়েছেন নওয়াজ।
সামরিক বাহিনী
পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ভাবা হয়ে থাকে সেনাবাহিনীকে। ৭৬ বছর আগে পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। এর মধ্যে কার্যত অর্ধেক সময় দেশটিতে সেনা শাসন ছিল। এমনকি বেসামরিক শাসনামলে দেশটির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে সামরিক বাহিনীর সুস্পষ্ট প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ দেখা গেছে।
পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ দেশ পাকিস্তান। ১৯৯৮ সালে ভারতের পরপরই পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হয়। তখন থেকেই পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের ‘অভিভাবক’ সামরিক বাহিনী।
নিয়মিত ও মজুত বাহিনী মিলিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্য প্রায় ১৫ লাখ। ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের দশম বৃহত্তম সেনাবাহিনী পাকিস্তানের।
অবাক করা বিষয় হলো, পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্থান-পতন অনেকাংশের সামরিক বাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। জেনারেলদের সমর্থনের ওপর ভরসা করেন রাজনৈতিক নেতারা। যদিও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বরাবরই নির্বাচনগুলোয় হস্তক্ষেপের অভিযোগ নাকচ করে এসেছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী শুধু আকারে বড়, তা নয়। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি জমির একক মালিকানা সেনাবাহিনীর হাতে। স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিয়েশন কাউন্সিল নামে একটি পর্ষদে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা রয়েছেন। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এটি। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানজুড়ে বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, দাতব্য সংগঠন পরিচালনায় অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের দাপট রয়েছে।
ইমরান খান
পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন ইমরান খান। জিতেছেন বিশ্বকাপ। তারকা ইমেজ কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে ইমরানের উত্থান। সেখানেও বাজিমাত করেন। তারকা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতির মাঠ—ক্যারিশমাটিক ইমরানের দাপট সবখানেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে নজর কেড়েছেন তিনি।
২০২২ সালের এপ্রিলে বড় ধাক্কা খান ইমরান খান। পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে সরকারপ্রধানের পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। তখন থেকে একের পর এক আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাঁকে। দুর্নীতি ও আইন অমান্য করে বিয়ে করাসহ একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ইমরান এখন কারাগারে। নির্বাচনে অযোগ্য হয়েছেন। এমনকি এক দশকের জন্য তাঁকে রাষ্ট্রীয় কোনো পদে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ইমরান খান সশরীর নেই। তবে ইমরান ও তাঁর দলের প্রভাব সর্বত্র। পাকিস্তানের রাজনীতিতে নেতাদের দীর্ঘদিন কারাগারে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ফের ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসাও অতীতে বহুবার দেখা গেছে। ক্যারিশমাটিক ও জনপ্রিয় ইমরান এটা বেশ ভালোই জানেন। ইমরান এখন সেই সময়ের অপেক্ষায়।
২০১৮ সালে ইমরান যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন পাকিস্তানিদের মধ্যে বেশ ভালো সমর্থন ছিল। তবে ইমরানের ক্ষমতায় আসার পেছনে সেনাবাহিনী কলকাঠি নেড়েছিল, এমন গুঞ্জনে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেকটা কমে যায়। ক্ষমতায় থাকার সময়ই বিভিন্ন ইস্যুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দেয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রচারণা শুরু করেন।
পরের ঘটনা সবাই জানেন। ইমরান গ্রেপ্তার হন। একের পর এক মামলায় জড়ানো হয় তাঁর নাম। চলে বিচার। সাজা পান তিনি। এর আগে সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাজপথে সংঘাতে জড়ান ইমরান খান ও পিটিআই সমর্থকেরা। এমনকি গত বছরের মে মাসে একটি সেনা সদর দপ্তরে তাঁর সমর্থকেরা ভাঙচুর চালান।
শাহবাজ শরিফ
নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ। তবে ভাইয়ের মতো ততটা ক্যারিশমাটিক নন তিনি। অনাস্থা ভোটে হেরে ইমরান খান বিদায় নিলে ২০২২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ।
বিশ্লেষকদের মতে, লন্ডনে অবস্থারত বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি শাহবাজ। পরে তো নওয়াজ দেশে ফেরেন। যদিও সামরিক বাহিনীর ভূমিকাসহ কিছু বিষয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
সাধারণত সাফারি শুট পরতে পছন্দ করেন শাহবাজ। প্রচণ্ড কাজপাগল মানুষ। নওয়াজ দলীয় প্রধান হলেও এবারের নির্বাচনে পিএমএল-এনের প্রচারের অন্যতম মুখ শাহবাজ। ভাইয়ের অবর্তমানে তিনি বড় বড় নির্বাচনী সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পিএমএল-এন এবারের নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করলে নতুন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে দেখা যাবে শাহবাজকে। আর এটা নিয়ে কোনো মহলে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি
পাকিস্তানের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ মুখ পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। বিখ্যাত ভুট্টো-জারদারি বংশের রক্ত বইছে তাঁর শরীরে। বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। মা ইতিহাস গড়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আইকনিক রাজনীতিক বেনজির ভুট্টো। ক্ষমতা আর ট্র্যাজেডি বিলাওয়ালের পূর্বসূরিদের নিত্যসঙ্গী।
বেনজির ভুট্টো শুধু পাকিস্তানের প্রথম নারী সরকারপ্রধান নন, তিনি মুসলিম জাহানে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। দুই দফায় দেশ চালিয়েছেন বেনজির। ২০০৭ সালে এক সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান তিনি। বিলাওয়ালের নানা ও বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের আলোচিত প্রধানমন্ত্রীদের একজন। ক্ষমতাচ্যুতির পর ১৯৭৯ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে বিলাওয়ালের বাবা আসিফ আলি জারদারিকে নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষমতার রাজনীতিতে তিনি ‘মিস্টার ১০ পারসেন্ট’ নামে পরিচিতি পান। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে এমন নামকরণ।
ইমরান খানের সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে পাকিস্তানে জোট সরকার গঠিত হয়। আর তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন পিপিপি নেতা বিলাওয়াল। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ৩৫ বছর বয়সী বিলাওয়াল এখন সরকার চালানোর প্রত্যাশা করছেন।
তবে এককভাবে সরকার গঠনের মতো সমর্থন না-ও পেতে পারেন বিলাওয়াল ও তাঁর দল পিপিপি। শুধু দক্ষিণাঞ্চলের সিন্ধু প্রদেশে পিপিপির বড় প্রভাব রয়েছে। তাই ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণে বিলাওয়ালকে জোটবদ্ধ রাজনীতির কৌশল বেছে নিতে হবে, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।