পাকিস্তানে দলীয় প্রতীক নিয়ে যত রাজনীতি
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেকোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কখনো একটি প্রতীক হয়ে ওঠে দলের পরিচয়। আর যদি কোনো দল সেই প্রতীক হারিয়ে বসে, তাহলে তাদের জন্য তা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশঙ্কার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন সেই আশঙ্কা ভর করেছে পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) ওপর। গত ২২ ডিসেম্বর দলটির ‘ব্যাট’ প্রতীক বাতিল করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। ইসিপির এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পিটিআই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু ইসিপির সিদ্ধান্তকেই বহাল রেখেছেন আদালত।
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এরই মধ্যে দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচার চলছে। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে দেয়াল। আর সেগুলোতে রয়েছে প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীক। কিন্তু সেখানে নেই ব্যাট প্রতীকে কোনো পোস্টার।
পিটিআইয়ের সদস্যরা ও সমর্থকেরা মনে করছেন, তাঁদের দলের পরাজয় নিশ্চিত করতে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ষড়যন্ত্র করে তাঁদের ব্যাট প্রতীক বাদ দিয়েছে।
এরই মধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারিও অভিযোগ করেছেন, তাঁর দলের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাত প্রার্থীকে পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশে ভুল নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, ইসিপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের চাপে এমনটা করছে।
দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোপন চুক্তি করে নওয়াজ দীর্ঘদিনের স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে দেশে ফিরেছেন। এই সেনাবাহিনী পেছন থেকে পাকিস্তানের সব স্তর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নওয়াজের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ হয়ে যাওয়ার পর গত অক্টোবরে তিনি দেশে ফেরেন।
পিটিআই কেন ব্যাট হারাল
নিয়ম অনুযায়ী দলের অভ্যন্তরীণ নেতা বাছাইয়ের নির্বাচন হয়নি, এমন টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে ইসিপি গত ২২ ডিসেম্বর দলটির প্রতীক বাতিল করেন। ফলে দলটি আসন্ন নির্বাচনে প্রতীক পাওয়ার জন্য অযোগ্য হয়ে পড়ে।
২০২২ সালের ৮ জুন পিটিআইয়ের নেতা ঠিক করতে দলীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয়। তবে এটি ‘যথাযথ ও স্বচ্ছ’ হয়নি বলে ইসিপি এই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইসিপি আরও ১৩টি প্রান্তিক রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশ দেন।
পিটিআইয়ের সমালোচক ও সমর্থকেরা মনে করেন, নির্বাচনে দলটির জয়কে কঠিন করে তুলতেই ইচ্ছাকৃতভাবে দলীয় প্রতীক বাতিল করা হয়েছে বলে মনে করছে। দলের আইনজীবী সাইদ আলী জাফর বলেন, ‘ক্রিকেট ব্যাটটি অন্যায়ভাবে অবৈধ আদেশের মাধ্যমে প্রত্যাহার করা হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে পিটিআই ও ইসিপির আইনি লড়াই সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। সেখানেই ইসির আদেশই বহাল থাকে। এই প্রতীক পিটিআইয়ের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এটি সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে ইমরান খানের সাফল্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালে পাকিস্তান যখন বিশ্বকাপ জেতে, তখন ইমরান ছিলেন অধিনায়ক।
নিউইয়র্কভিত্তিক রাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ভিজিয়ার কনসাল্টিংয়ের সভাপতি আরিফ রফিক বলেন, পিটিআইয়ের প্রতীক ব্যবহার করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। ইমরান খানের জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, জবরদস্তি করে পাকিস্তানের প্রশাসনিক যন্ত্রকে ব্যবহারের নমুনার অংশ হয়ে গেছে তারা। নির্বাচনে তাদের জয়ের পথ বন্ধ করে দিতে এসব করা হচ্ছে।
জিও টেলিভিশনের নির্বাচনী সেলের প্রধান নাদিয়া মালিক বলেন, আন্তদলীয় নির্বাচন পাকিস্তানে একটি নাটক। কিন্তু ইসিপি অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনেনি।
নাদিয়া আল–জাজিরাকে বলেন, পাকিস্তুানে প্রতীক হারানো নতুন কিছু নয়। কিন্তু পিটিআই তাদের প্রার্থীদের জন্য অন্য কোনো প্রতীকও বেছে নিতে পারেনি। কারণ, ততদিনে প্রতীক বরাদ্দের সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ইসিপি নিজেদের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, প্রতীক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে প্রয়োজনে নির্বাচন আরও পিছিয়ে দেওয়া হবে।
এ নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হবে, তা বেশ ভালোই আঁচ করতে পেরেছে পিটিআই। তাই এই সংকট মোকাবিলা করতে দলের সোশ্যাল মিডিয়া টিম একটি পোর্টাল নিয়ে কাজ করছে। এই পোর্টালে ভোটাররা নির্দিষ্ট আসনে পিটিআইয়ের প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক অনুসন্ধান করে দেখতে পারবেন। নাদিয়া বলেন, ‘পিটিআই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারকাজে সত্যিই ভালো করছে।’
তবে পাকিস্তানে প্রতি দুজনের মধ্যে একজনের স্মার্টফোন নেই। ফলে প্রতিটি ভোটারের কাছে তাঁদের পৌঁছানোটা কঠিন।
সংবিধবান বিশেষজ্ঞ আসাদ রহিম খান বলেন, ইসিপির শেষ সিদ্ধান্তের পরিণতি এবং সুপ্রিম কোর্টের এতে ‘হ্যাঁ’ সুর মেলানোর অর্থ হলো লাখো ভোটারকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং নির্বাচনের দৌড় থেকে দেশের সবচেয়ে বড় দলটিকে বাইরে রাখা।
পিটিআইয়ের ব্যাটের পেছনের গল্প
কাত হয়ে থাকা ক্রিকেট ব্যাট ইমরান খানের দলের সঙ্গে সর্বোতভাবে মিশে আছে। কিন্তু শুরুর দিকে এটি দলের প্রতীক ছিল না। নাদিয়া জানান, দলের প্রথম প্রতীক ছিল বাতি।
২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে পিটিআই তাদের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে চেয়েছিলেন দাঁড়িপাল্লা। যদিও এটি পাকিস্তানে ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এটি ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে জামায়াত–ই–ইসলামির প্রতীক ছিল। এই প্রতীক নিয়ে দুই দলের মধ্যে আইনি লড়াই চলে। পরে অবশ্য ঐতিহাসিক যুক্তির জোরে এটি জামায়াতেরই থাকে।
১৯৭৭ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক সরকার অনুমোদিত অনেক নির্বাচনী প্রতীক থেকে কিছু প্রতীক বাতিল করে। ২০১০ সালে ইসিপি আবারও এই প্রতীক ফিরিয়ে দেয়।
নির্বাচনী প্রতীক কেন গুরুত্বপূর্ণ
এই প্রতীক দেখতে যৎসামান্য কিছু মনে হতে পারে। তবে পাকিস্তানের মতো দেশে এই প্রতীকের গুরুত্ব অনেকখানি।
জিও টিভির সাংবাদিক নাদিয়া বলেন, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যান ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত, যাঁরা পড়তে পারেন না। তাই তাঁরা দলের প্রতীক দেখেই বুঝতে পারেন, তাঁরা কাকে ভোট দিচ্ছেন। নাদিয়া বলেন, এমনকি যাঁরা প্রার্থীর নাম পড়তে পারেন, কিন্তু দলের নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে সেভাবে জড়িত নন, তাঁরাও তাঁদের দলের প্রতীক দেখেই ভোট দেন।
নাদিয়া আরও বলেন, এমনকি দেখা যায়, দলের প্রতীক ঘিরেই তৈরি হয় নির্বাচনী স্লোগান ও গান।
উদাহরণস্বরূপ, ‘বাল্লায় কো দিয়া কিস নায় সাহারা—পাতেল পাড়া পাতেল পাড়া’—যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, যাঁরা ব্যাট সমর্থন করে, সেই হচ্ছে পাতেল পাড়া পাতেল পাড়া। পিটিআইয়ের নির্বাচনী মিছিলে করাচির পাতেল পাড়া এলাকার সমর্থকেরা এই স্লোগান বানিয়েছেন।
একইভাবে নওয়াজ শরিফের পিএমএল–এন ও ভুট্টো–জারদারির পিপিপির সমর্থকেরাও দলীয় প্রতীক নিয়ে নানা স্লোগান ও গান বানান।
পিএমএল–এন–র বাঘ
মধ্যডানপন্থী পিএমএল–এন দলটি তাদের প্রতীক বাঘের জন্য বেশ পরিচিত। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শরিফের নেতৃত্বাধীন এই দলটির প্রতীক আগে এটি ছিল না।
আগে দলটি ডানপন্থী জোট ইসলামি জামহুরি ইত্তেহাদের (আইজেআই) শরিক দল ছিল। তখন জোটটি প্রতীক হিসেবে সাইকেল ব্যবহার করত। মালিক বলেন, পিএমএল-এন তাই সাইকেল প্রতীক ব্যবহার করতে পারেনি।
এরপরই পার্টির প্রতীক হিসেবে বাঘের ছবি প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। আর শরিফ পেয়ে যান ‘পাঞ্জাবের সিংহ’ উপাধি। পাঞ্জাব প্রদেশে পিএমএল-এন ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিল। সেখানে তাদের সমর্থনও ছিল বেশি।
২০১৭ সালে পিএমএল-এন প্রায় একই পরিস্থিতিতে পড়েছিল, যেমনটা এখন পিটিআইয়ের। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করার পর দলের নতুন প্রধান নির্বাচন করতে ব্যর্থতার কারণে তাদের বাঘ প্রতীক সমায়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল। অবশ্য পিএমএল-এন নতুন প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন তার সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেয়।
তরবারি ও তির—পিপিপির গল্প
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সামাজিক গণতান্ত্রিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতীক ছিল তরবারি। ২০১৭ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জুলফিকার আলী ভুট্টো তরবারি বেছে নিয়েছিলেন। এর পেছনে তাঁর যুক্তি ছিল মহানবী (সা.) চাচাতো ভাই ও জামাতা এবং চতুর্থ খলিফা আলী বিন আবু তালিবের তরবারির নাম ছিল জুলফিকার।
একটি সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠার জন্য ভুট্টোকে ইসলামবিরোধী বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপর তিনি প্রতীক হিসেবে তরবারিকে বেছে নেওয়ার পেছন ধর্মীয় এই অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন।
তবে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক অনুমোদিত এই প্রতীকের তালিকা থেকে তরবারি বাদ দিলে দলটি ‘তির’ প্রতীক ব্যবহার শুরু করে।
যাহোক, ২০১৮ সালে ভুট্টোর নাতি বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি তরবারি ফিরিয়ে আনার জন্য পিপিপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে ওঠা দলটির বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন এবং জিতেছিলেন। যার অর্থ তরবারি প্রতীক অন্য কোনো পক্ষকে দেওয়া হবে না।
তবে এই নির্বাচনে পিপিপির নির্বাচনী প্রতীক তিরই থাকছে।
বেলুন, ঝাড়ু, ডলফিন
প্রধান তিনটি দল পিটিআই, পিএমএল-এন এবং পিপিপি ছাড়াও আও ১৪৫টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তারা ঝাড়ু, বেলুন থেকে হাতঘড়ি পর্যন্ত প্রতীক ব্যবহার করে ভোটের মাঠে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের খবরে বলা হয়, পাসবান ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রাথমিকভাবে প্রতীক হিসেবে ঘাসফুলের ঝাড়ু চেয়েছিল। এটিকে তারা দেশের দুর্নীতি পরিষ্কার করার প্রতীকী হিসেবে মনে করেছিল। কিন্তু এর পরিবর্তে তাদের দেওয়া হয় বেলুন।
পাসবান ডেমোক্রেটিক পার্টির পরিবর্তে ঝাড়ুটি পাকিস্তান আওয়ামী রাজ পার্টিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। দলটি শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে সংহতি ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
ইতিমধ্যে ইসিপি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ক্যারম বোর্ড, ডিপ ফ্রিজার, ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে।