পাকিস্তানের নির্বাচনে এগিয়ে কোন কোন দল, কারা পিছিয়ে
পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রায় ২৫ কোটি পাকিস্তানি নতুন সরকার গঠনে তাঁদের রায় দেবেন।
এমন সময় এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) অনেকটাই বেকায়দায় পড়েছে এবং দেশটিতে ‘ঘোলাটে’ রাজনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করছে।
বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশের মতো পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোরও নানা ধরনের মতাদর্শিক অবস্থান রয়েছে।
এখানে দেশটির প্রধান দলগুলোসহ যারা জাতীয়ভাবে ক্ষমতায় রয়েছে, যাদের উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রভাব রয়েছে এবং ছোট হওয়ার পরও সেসব দল দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে, তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো—
পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন)
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বে মধ্যপন্থী পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ ২০১৩ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে।
তবে শরিফকে (৭৪) ২০১৭ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তিনি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের কয়েক দিন আগে তাঁর সঙ্গে মেয়ে মরিয়মকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নওয়াজের ছোট ভাই ও দলের শক্ত ঘাঁটি পাঞ্জাবের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নামের একটি জোটের অংশ হিসেবে পিএমএলএন পরে ইমরান খান ও তাঁর সরকারের প্রতি অনাস্থা আনে। এতে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসা ইমরান পদচ্যুত হন।
২০১৮ সালে আসন জয়: ৬৪
২০১৩ সালে আসন জয়: ১২৬
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)
ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খানের হাতে প্রতিষ্ঠিত পিটিআই। বর্তমানে এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন গোহর আলী খান। দলটির ঝোঁক এখন মধ্য ডানপন্থায়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসেন ইমরান। ধারণা করা হয়, ওই নির্বাচনে ইমরানের পক্ষে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সামরিক বাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়। এর জেরে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন ঘটনা এটাই প্রথম।
ইমরানের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে মিলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট সবাই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পদচ্যুতের পর ইমরান আগাম নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন।
এই বিক্ষোভে একপর্যায়ে গত বছরের মে মাসে দুর্নীতির অভিযোগে ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা বেসামরিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে তাণ্ডব চালান।
ইমরানের বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক মামলা করা হয়েছে। এরই মধ্যে চারটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় উপহারসামগ্রী কম মূল্যে কিনে নেওয়ার অভিযোগে করা (তোশাখানা) মামলায় ইমরান ও তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবিকে ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দেন বিশেষ একটি আদালত। এর এক দিন আগে ৩০ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁসের মামলায় ইমরান খানের ১০ বছরের জেল দেওয়া হয়। একই মামলায় ইমরান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশিকেও ১০ বছরের জেল দেন আদালত। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি শরিয়াহ আইন লঙ্ঘন করে বিয়ে করার দায়ে ইমরান ও বুশরাকে সাত বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এর আগে গত বছরের ৫ আগস্ট তোশাখানা দুর্নীতি নিয়ে পৃথক একটি মামলায় ইমরানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ইমরানের দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘ক্রিকেট ব্যাট’ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এর প্রার্থীরা এখন স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এসব প্রতিবন্ধকতার পরও দেশজুড়ে পিটিআইয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিষয়টি ইমরানের জন্য সুবিধা দিতে পারে।
২০১৮ সালে আসন জয়: ১১৬
২০১৩ সালে আসন জয়: ২৮
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ও তাঁর বাবা আসিফ আলী জারদারির নেতৃত্বে মধ্য-বামপন্থী পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ২০০৮ সালের পর প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে।
দলটি প্রতিষ্ঠা করেন বিলাওয়ালের মাতামহ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরে তাঁর মা ও পাকিস্তানের দুবারের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এর নেতৃত্ব ছিলেন। ৩৫ বছর বয়সী বিলাওয়ালকে যোগ্য উত্তরসূরি হওয়ার জন্য অনেক কিছু করার আছে।
বিলাওয়াল দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২০২২ সালে ইমরানের ক্ষমতাচ্যুতির পর তিনি ১১ দলীয় জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (পিডিএম) শাসনামলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
২০১৮ সালে আসন জয়: ৪৩
২০১৩ সালে আসন জয়: ৩৪
আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি)
পশতুন জাতীয়তাবাদী আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির ভিত্তি মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খাইবারপাখতুনখাওয়ায়। দলটি প্রাদেশিক সরকারে থাকা পিটিআইকে পরাস্ত করতে চায়।
আসফান্দিয়ার ওয়ালি খানের নেতৃত্বাধীন মধ্য-বামপন্থী দলটি নীতিগতভাবে প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ। তবে দলটি দুর্নীতির অভিযোগে ভুগছে এবং প্রায় দুই দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে।
এএনপি ১১-দলীয় জোট পিডিএমের শরিক ছিল।
২০১৮ সালে আসন জয়: ১
২০১৩ সালে আসন জয়: ২
মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি)
মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান প্রায় তিন দশক ধরে দেশটির বৃহত্তম শহর ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত করাচির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিল।
অতীতে তারা সব সময় জাতীয়ভাবে দেশের নেতৃত্বদানকারী দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করেছে। দলটি ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পিটিআইয়ের সঙ্গে জোটে বেঁধেছিল। তবে ২০২২ সালের এপ্রিলের পর তারা পিডিএমের সঙ্গে হাত মেলায়।
২০১৮ সালে আসন জয়: ৬
২০১৩ সালে আসন জয়: ১৮
জামাত-ই-ইসলামি (জেআই)
সিরাজ উল হকের নেতৃত্বাধীন দলটি দক্ষিণপন্থী। তাদের ইশতেহারের মূল বিষয়ই ধর্মকে ঘিরে।
পাকিস্তানের অন্যতম পুরোনো দলটি সাংগঠনিকভাবে বেশ শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত, তবে ভোটের লড়াইয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে দলটি। তবে ২০০২ সালের নির্বাচনে তারা ভালো করেছিল। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ক্যুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা জেনারেল পারভেজ মোশাররফের অধীন।
২০১৮ সালে আসন জয়: ১২ (ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জোটের অংশ হিসেবে)
২০১৩ সালে আসন জয়: ২
জমিয়ত-ই-উলেমা ইসলাম (জেইউআই-এফ)
ফজল-উর-রেহমানের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী দলটির লক্ষ্য হারানো আঞ্চলিক ময়দান পুনরুদ্ধার। বিশেষ করে খাইবারপাখতুনখাওয়া প্রদেশের ক্ষমতা ফিরে পেতে চায় তারা। প্রদেশটিতে পিটিআইয়ের কাছে হেরেছে তারা।
ফজল-উর-রেহমান পিডিএম জোটেরও প্রধান। তিনি তাঁর বিস্তৃত ধর্মীয় যোগাযোগ ব্যবহার করে ভোটে ভালো করতে মরিয়া।
২০১৮ সালে আসন জয়: ১২ (ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জোটের অংশ হিসেবে)
২০১৩ সালে আসন জয়: ১১
পাখতুনখাওয়া মিলি আওয়ামী পার্টি (পিকেএমএপি)
পশতুন জাতীয়তাবাদী দলটি মূলত বেলুচিস্তান প্রদেশে সক্রিয়। প্রদেশটির সবশেষ জোট সরকারের শরিক ছিল পিকেএমএপি।
প্রগতিশীল মধ্য-বামপন্থী হিসেবে বিবেচিত দলটির নেতৃত্বে আছেন মাহমুদ খান আচাকজাই। পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশটির জাতীয় পরিষদের সবচেয়ে কম আসন (১৬) রয়েছে।
২০১৮ সালে আসন জয়: শূন্য
২০১৩ সালে আসন জয়: ৩
বালুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)
২০১৮ সালে বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির যাত্রা শুরু। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
সূচনাকাল থেকেই দলটিতে বেলুচিস্তানের বিভিন্ন উপজাতির অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতিবিদদের সম্মিলন ঘটেছে এবং পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রাখার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি পিটিআইয়ের সঙ্গে জোট গঠন করেছিল।
২০১৮ সালে আসন জয়: ৪
২০১৩ সালে আসন জয়: প্রযোজ্য নয়
আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টি (এডব্লিউপি)
বামপন্থী আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টি অন্যান্য মূলধারার দলগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত নতুন ও শক্তিতেও নগণ্য। দলটি কৃচ্ছ্রসাধনবিরোধী প্রচার চালিয়ে আসছে।
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মোহভঙ্গে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে তারা
এবং এ ক্ষেত্রে বিকল্প তুলে ধরছে। যদিও সারা দেশে জাতীয় পরিষদের মাত্র তাদের তিন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২০১৮ সালে আসন জয়: শূন্য
২০১৩ সালে আসন জয়: শূন্য
হাকুক-ই-খালক পার্টি (এইচকেপি)
২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সমাজতান্ত্রিক হাকুক-ই-খালক পার্টি। লাহোরে পিএমএলএনের শক্তঘাঁটিতে তরুণদের প্রার্থী করেছে দলটি।
এডব্লিউপির মতো এইচকেপিকেও আর্থিক তহবিলসংকটে ভুগতে হচ্ছে। এ কারণে আরও বেশি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী দিতে পারছে না। শুধু একটি শহরে দুজন জাতীয় পরিষদের প্রার্থী ও একজন প্রাদেশিক প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এইচকেপি।
২০১৮ সালে আসন জয়: প্রযোজ্য নয়
২০১৩ সালে আসন জয়: প্রযোজ্য নয়
ইসতেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি (আইপিপি)
গত বছরের জুনে ইসতেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তানের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর তারিন। অতীতে তিনি ইমরানের ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন ছিলেন এবং পিটিআইয়ে অনুদান দিতেন।
গত বছর ইমরানের পিটিআই রাষ্ট্রীয় পীড়নের মুখোমুখি হওয়ার মাত্র এক মাস পর মধ্যপন্থী দলটি আত্মপ্রকাশ করে।
২০১৮ সালে আসন জয়: প্রযোজ্য নয়
২০১৩ সালে আসন জয়: প্রযোজ্য নয়
স্বতন্ত্র
আইনি জটিলতার কারণে পিটিআইয়ের প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। এর বাইরে এ নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীও দেখা যাবে, যাঁরা কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন।
এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতে পিটিআইয়ে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এবার তাঁরা নিজেরাই স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন অংশ নিচ্ছেন। বাকিরা মূলধারার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই তরুণ।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রায় সব সময়ই জাতীয় পরিষদে সর্বাধিক আসন পাওয়া দলের সঙ্গে যোগ দেন।
২০১৮ সালে আসন জয়: ১৩
২০১৩ সালে আসন জয়: ২৭