রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া ইউরোপের চলা সম্ভব নয়

সিঙ্গাপুর উপকূলে এলএনজিবাহী জাহাজ
ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়ায় পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে দেশটির ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো।এরই অংশ হিসেবে রাশিয়া থেকে গ্যাস নেওয়া কমাতে চাইছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে ইউরোপে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তাতেই সমাধান হচ্ছে না। রাশিয়া–নির্ভরতা কমাতে অন্য উপায় খুঁজতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে।

এমন প্রেক্ষাপটে কাতারের জ্বালানিমন্ত্রী সাদ শেহরিদা আল-কাবি বলছেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ইউরোপের নির্ভরতার বিকল্প উৎস বাস্তবে পাওয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সারা বিশ্বে সরবরাহ করা গ্যাসের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে। এর বিকল্প খুঁজতে ইউরোপের সবাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার যে বিকল্প উৎস খুঁজছে, সেটা মোটেও সহজ হবে না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) আমদানি করা গ্যাসের ৪০ শতাংশেরও বেশি যায় রাশিয়া থেকে। চলতি বছরেই রাশিয়া থেকে গ্যাস–নির্ভরতা কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে তারা। বিশ্বের শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে কাতার অন্যতম। সে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশের দিকে ঝুঁকছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর নেতারা।

গত সপ্তাহে গ্যাস নিয়ে এক ধরনের সমঝোতায় পৌঁছানোর পর কাতারের রাজধানী দোহা ছাড়েন জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হেবেক। যদিও এই মুহূর্তে কাতার থেকে সরাসরি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আনার কোনো টার্মিনাল নেই জার্মানির। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য গত শুক্রবার একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।

কাতারের জ্বালানিমন্ত্রী বলেন, গত চার বছরে গ্যাস শিল্প বিকাশে বড় বড় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে তাঁর দেশ। এর মধ্যে নর্থ ফিল্ডের গ্যাসের সম্প্রসারণ করে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা ৬০ শতাংশেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে। তারা এখন উত্তোলিত মোট গ্যাসের অর্ধেকেরও বেশি ইউরোপে রপ্তানি করতে চাইছেন।

কাতারের জ্বালানি মন্ত্রী সাদ শেহরিদা আল-কাবি
ছবি: রয়টার্স

সাদ শেহরিদা আল কাবি বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা হলো, মোট গ্যাসের ৫০ শতাংশ সুয়েজ খালের পশ্চিমে আর বাকি ৫০ শতাংশ সুয়েজ খালের পূর্বের দেশগুলোতে রপ্তানি করা। বর্তমানে কাতারের প্রাকৃতিক গ্যাসের ৮০ শতাংশ ক্রেতাই এশিয়ার দেশগুলো। এসব দেশের সঙ্গে কাতারের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে, যার ফলে অন্য দেশে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ খুবই সীমিত।’

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে যেসব দেশে, সেগুলোর অন্যতম রাশিয়া। পরিমাণের দিক দিয়ে যা কাতারের প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাস্তবে রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প অন্য দেশের হওয়ার সুযোগ প্রায় অসম্ভব।

রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কাতারের গ্যাস চাইলে ইউরোপের সামনে একটি পথই খোলা রয়েছে। আর সেটি হলো, কাতার যেসব দেশের সঙ্গে গ্যাস রপ্তানির চুক্তি করেছে সেগুলো বাতিল করা। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে, যা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। এটা করতে হলে চুক্তি অনুযায়ী সেসব দেশ কাতারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে।

কাতারের কারিগরি প্রতিবন্ধকতা

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে রাশিয়া থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ অনেক সহজ। কিন্তু কাতার থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের কোনো পাইপলাইন নেই। এ কারণে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করতে হলে এলএনজি জাহাজে করে নিতে হবে।

এ বিষয়ে দুবাইভিত্তিক জ্বালানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কামার এনার্জির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রবিন মিলস বলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির উদ্বৃত্ত নেই। এ ছাড়া কাতারের এলএনজিরও বিকল্প নেই।

নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাসলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের কথা ছিল রাশিয়ার
ছবি: রয়টার্স

ইউরোপে এলএনজি আমদানির আরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন লন্ডনের ইমপিরিয়াল কলেজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ইউসুফ আলসামারি। তিনি বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ অনেক ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। কারণ, এর মাধ্যমে কার্বন নির্গমন হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর। তিনি আরও বলেন, কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী জলবায়ু এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের জন্য কঠিন হবে।

এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো কারেন ইয়াং বলেন, কাতার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস জাহাজের মাধ্যমে ইউরোপে নিতে হলে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, যেটি সময়সাপেক্ষ। ইতিমধ্যে যেসব দেশ কাতার থেকে গ্যাস আমদানি করছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকায় বিষয়টি তাদের জন্য অনেক সহজ।

কাতার-রাশিয়া সম্পর্কের কী হবে

রাশিয়ার সঙ্গে কাতারের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো গ্যাসের জন্য কাতারের দিকে ঝুঁকলে সে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে কি না—সেটাও দেখার বিষয়। তবে কাতারের জ্বালানিমন্ত্রী সাদ শেহরিদা আল কাবি বলেছেন, রাজনীতির সঙ্গে জ্বালানি টেনে আনার পক্ষে নন তিনি। গ্যাস নিয়ে করা চুক্তিকে বাণিজ্যিকভাবেই দেখতে চান।