ইসরায়েল সব সময়ই দেখে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র তার পাশেই আছে। আত্মরক্ষার অধিকারের নামে ফিলিস্তিনে হামলা চালানোর ব্যাপারে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা-সমর্থনের পাশাপাশি ইসরায়েলের ভান্ডারে রয়েছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র। আর আছে ‘গর্বের’ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা—আয়রন ডোম। এসব ভরসায় এবারও গাজায় হামলে পড়ে ইসরায়েল। হামলা চালাতে গিয়ে ইসরায়েল অন্তত দুটি ধাক্কা খেয়েছে।
তো কী সেই দুই ধাক্কা?
১.
সেই ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টই ইসরায়েলের হামলা সমর্থন দিয়ে এসেছেন। এই ধারা অনুসরণ করে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই পথে হেঁটেছেন। ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ আছে বলে জোর গলায় ঘোষণা দেন তিনি। এই কথা বলার মধ্য দিয়ে বাইডেন মূলত গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচারে নৃশংস হামলার পক্ষে তাঁর অবস্থান জানান দেন। এই অবস্থান জানান দেওয়ার পরই বাইডেনের সামনে ‘নতুন বাস্তবতা’ হাজির হয়। তিনি তাঁর ডেমোক্রেটিক দলের ভেতরেই সমালোচনার পাশাপাশি চাপের মুখে পড়েন। চাপে পড়ে বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে দফায় দফায় ফোন করে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। শেষমেশ ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান শিবির এত দিন প্রায় শর্তহীনভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। এখন বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট শিবিরে ইসরায়েল প্রশ্নে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনকে নাটকীয় ও গভীর বলে বর্ণনা করছেন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা।
ডেমোক্র্যাট দলের উদারপন্থীরা মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, শান্তির পক্ষে। তাঁরা বর্ণবাদ, বৈষম্য, আগ্রাসন, নিপীড়ন, দখলদারি, যুদ্ধ, সংঘাতের বিরুদ্ধে। এবার গাজায় ইসরায়েলি হামলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘরানার পক্ষ ‘ফিলিস্তিনি লাইভস ম্যাটার’ বলে আওয়াজ তোলা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ‘কেন শুধু ইসরায়েলের ওপর রকেট হামলা হলেই আমরা সেই ঘটনার দিকে নজর দিই?...আমাদের অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে যে ফিলিস্তিনিদের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের জীবনও গুরুত্বপূর্ণ।’
বিমানবন্দরের টারম্যাকে বাইডেনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা রাশিদা তালিব ফিলিস্তিন ইস্যু তুলে ধরে আলোচনার জন্ম দেন। তিনি তাঁর উদ্বেগের কথা, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের কথা বাইডেনকে বোঝাতে সক্ষম হন বলে খবর বের হয়।
বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের একতরফা সমর্থনের ধারায় পরিবর্তন আনতে উদার, মধ্যপন্থী ও একদল তরুণ ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতাদের মধ্যে জোর প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। মার্কিন রাজনীতির নতুন এই হাওয়া ইসরায়েলের জন্য প্রতিকূল হয়ে দেখা দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, তাদের ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ পাওয়া আগের মতো আর সহজ হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থী নাগরিকদের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমানুভূতি-সমর্থন দেখা যাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ ও ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। এসব বিক্ষোভে হাজারো মানুষ শামিল হয়েছেন।
২.
ইসরায়েল দ্বিতীয় ধাক্কাটি খেয়েছে তাদের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ নিয়ে। এবার গাজা থেকে হামাসের ব্যাপক রকেট হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আয়রন ডোমের দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে।
ইসরায়েল ২০০৬ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছিল। তখন হিজবুল্লাহ ইসরায়েল লক্ষ্য করে হাজারো রকেট ছোড়ে। হিজবুল্লাহর রকেটে ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মূলত তারপরই অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। ২০১১ সালে তারা প্রথম ‘আয়রন ডোম’ মোতায়েন করে।
এবার ইসরায়েলি হামলার জবাবে গাজা থেকে হামাস ৪ হাজারের বেশি রকেট ছোড়ে। ১১ দিনের সংঘাতে হামাস আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ হারে রকেট ছোড়ে। ফলে দেখা যায়, হামাসের ছোড়া অনেক রকেটই ইসরায়েলের আয়রন ডোমকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। হামাসের অনেক রকেট ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছে। এতে ইসরায়েলের জানমালের ক্ষতি হয়েছে।
আয়রন ডোমের এই দুর্বলতার কথা ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর বিবরণেই উঠে এসেছে। এটা ইসরায়েলের জন্য একটা বড় ধাক্কাই বটে। এমনকি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বক্তব্যেও আয়রন ডোমের দুর্বলতার প্রসঙ্গ আসে। আয়রন ডোম প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পুনরায় গড়ে তুলতে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করবে বলে জানান তিনি।
দুটি ধাক্কাই এসেছে ইসরায়েলের বড় ‘ভরসার’ জায়গা থেকে। যখন কোনো ভরসার জায়গা থেকে ধাক্কা আসে, তার চোটটা একটু বেশিই লাগে। ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই ধাক্কা সামলাতে ইসরায়েল কী পদক্ষেপ নেয়, তা-ই এখন দেখার।