ইয়েমেনে এই মৃত্যুর মিছিল কবে শেষ হবে?
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে প্রায় চার বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। দেশটির বিভিন্ন অংশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে আবার সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে—রাজায় রাজায় যুদ্ধ হচ্ছে, আর উলুখাগড়ার প্রাণ যাচ্ছে!
রাজারা যাদের উলুখাগড়া মনে করেন, তারা হলেন ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ বা জনগণ। ইয়েমেনে গত কয়েক বছরের গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আশু ব্যবস্থা না নিলে মৃত্যুর তালিকা আরও দীর্ঘ হবে। কিন্তু কেন ইয়েমেনে দিনের পর দিন ধরে চলছে এই যুদ্ধ? আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোই বা কেন উচ্চবাচ্য করছে না? যুদ্ধ চলতে থাকলে কোন অবস্থায় পৌঁছাবে ইয়েমেন?
আসুন, এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া যাক।
যুদ্ধের শুরু যেভাবে
ইয়েমেনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইন্ধন জুগিয়েছিল আরব বসন্ত। ক্ষমতার পালাবদলের আগে ইয়েমেনের দীর্ঘকালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একনায়ক আলী আবদুল্লাহ সালেহ। প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালে আবদ রাব্বু মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুরু থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন হাদি। একদিকে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, অন্যদিকে ইয়েমেনের দক্ষিণে বিস্তার লাভ করছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ। আর হুতি বিদ্রোহীরা তো ছিলই।
ইয়েমেনে ওই সময় আরও কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। আগের প্রেসিডেন্টের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য ছিল বিব্রতকর। দুর্নীতি, খাদ্যাভাব ও বেকারত্বের উচ্চ হারের মতো বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে ইয়েমেন। এর মধ্যে শিয়া ধর্মাবলম্বী হুতিরা নতুন করে বিদ্রোহ শুরু করে। নতুন প্রেসিডেন্ট হাদির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উত্তর ইয়েমেনের ‘সাদা’ প্রদেশ এবং এর আশপাশের এলাকা দখল করে নেয় হুতিরা।
এ সময় সুন্নিসহ অনেক সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিকও হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছিল। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সানা দখল করে নেয় হুতিরা। ফলে ইয়েমেনে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। একটি সরকার পক্ষ, আরেকটি হুতি বিদ্রোহীরা। আলী আবদুল্লাহ সালেহর সমর্থক সেনারাও হাত মিলিয়েছিল হুতিদের সঙ্গে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে এমন বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আবদ রাব্বু মনসুর হাদি।
শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সহযোগিতা করছে—এমন অভিযোগ তুলে এর পরপরই দৃশ্যপটে আসে সৌদি আরব। সৌদিদের পক্ষে যোগ দেয় আরব বিশ্বের সুন্নিপ্রধান আরও ৮টি দেশ। শুরু হয়ে যায় হাদির পক্ষে জোটগত সামরিক অভিযান। এই জোটকে গোয়েন্দা তথ্য ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।
সেই থেকে ইয়েমেনে হানাহানি চলছেই।
সৌদি আরব যেভাবে যুদ্ধে
২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ শুরু করে। আবদ রাব্বু মনসুর হাদির সমর্থনে এই বিমান হামলা শুরু হয়। নির্বাসনে থেকেই ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হাদি এই অভিযানে সমর্থন দেন। হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সমর্থন দিচ্ছে বলে বিশ্বাস করে সৌদি আরব। কারণ ইরান ও হুতি বিদ্রোহী—দুইই শিয়া ধর্মাবলম্বী। সুন্নি সৌদি আরব তাই মনে করে, ইরানের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই হুতিরা এত রণংদেহী হয়ে উঠেছে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে সৌদিকে। কারণ ইরান, রাশিয়া ও চীনকে মধ্যপ্রাচ্যে ঠেকাতে চায় ট্রাম্পের দেশ।
মানুষ মরছে ঝাঁকে ঝাঁকে
চার বছরের বেশি সময়ের যুদ্ধে বিপর্যস্ত ইয়েমেন। এই দেশটিতে ঘটা মানব বিপর্যয় পরিস্থিতি বিশ্বের মধ্যে নিকৃষ্ট। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মার্চের পর থেকে এ পর্যন্ত সাত হাজারেরও বেশি মানুষ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি মানুষ। নিহতদের ৬৫ শতাংশের মৃত্যুর কারণ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের ফেলা বোমা। আর বাকিদের মৃত্যুর কারণ হুতি বিদ্রোহীরা।
তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্টের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জানুয়ারির পর থেকে এ পর্যন্ত ইয়েমেনে সহিংসতায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৬৭ হাজারের বেশি। অন্যদিকে ইয়েমেনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশের বা ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের প্রয়োজন মানবিক সহায়তা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইয়েমেনে প্রায় ৮৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। এ সব শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল। দেশটির প্রায় ২ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সুবিধা পাচ্ছে না।
এ সব কারণে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ইয়েমেনে ভয়ংকর রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা রোগ। ওই সময় কলেরায় প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি আবার সেখানে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ অন্যান্য দেশের দেওয়া অবরোধের কারণে দেশটিতে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট এতটাই তীব্র যে, আবর্জনাবাহী গাড়ি চালানোর মতো তেলও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সানাসহ কিছু এলাকায় আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থের স্তূপ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে ফের কলেরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করবে।
ইউনিসেফের মতে, শিক্ষকদের বেতন দুই বছর ধরে বন্ধ থাকায় অচিরেই অন্ধকারে তলিয়ে যেতে পারে ইয়েমেনের প্রায় ৩৭ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ। যুদ্ধের কারণে এমনিতেই দেশটিতে প্রায় ২০ লাখ শিশু-কিশোর নিয়মিত পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়েছে। আবার দেশটির পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৮ লাখ শিশু ভুগছে মারাত্মক পুষ্টিহীনতায়।
ইয়েমেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দরিদ্র দেশ। ইউএনডিপির দেওয়া সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান গৃহযুদ্ধ যদি ২০২২ সাল পর্যন্ত চলে, তবে ইয়েমেন পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশে পরিণত হবে। তখন দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭৯ শতাংশ চলে যাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে। অন্যদিকে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, লৈঙ্গিক সমতার দিক থেকে ইয়েমেনে নারীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
চলমান যুদ্ধে ঘরছাড়া হয়েছে ইয়েমেনের লাখ লাখ মানুষ। সংঘাতে ঘর ছেড়েছে দেশটির ৩৩ লাখেরও বেশি মানুষ।
এক কথায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে মানুষের জীবনের দামই সবচেয়ে সস্তা। এর চেয়ে ঢের দামি বুলেট-বোমা!
ভাঙনের গল্প
গৃহযুদ্ধের শুরুতে আলী আবদুল্লাহ সালেহ-এর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল হুতিরা। কিন্তু ২০১৭ সালের নভেম্বরে সেই সন্ধি ভেঙে যায়। সানার সবচেয়ে বড় মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে এই দুই পক্ষের সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল। ওই মসজিদ দখলে নিয়েই হুতি বিদ্রোহীরা ঘোষণা দেয় যে, সালেহকে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনার পরই সরকার সমর্থিত বা হাদির পক্ষের শক্তিগুলোর সম্পর্কে ভাঙন দেখা দেয়। দক্ষিণ ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রথমে হাদির বাহিনীর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুললেও, পরে তা নষ্ট হয়ে যায়। ইদানীং উপকূলবর্তী এডেনের দখল বুঝে নিয়েছে সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এসটিসি)। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের সেনাদের সঙ্গে এই এসটিসির সখ্য রয়েছে। সম্প্রতি ইয়েমেন থেকে সেনা প্রত্যাহারেরও ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ফলে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট পড়েছে বিপদে।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
ইয়েমেনে চলা গৃহযুদ্ধ আরব বিশ্বে অস্থিরতার অন্যতম প্রধান কারণ। দেশটিতে চলা সংঘাত-সহিংসতার কারণে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এখান থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালানোর নীল নকশা হচ্ছে। তাই ইয়েমেনের যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইয়েমেনে চলা যুদ্ধ এক অর্থে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার ছায়াযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ইরান ও সৌদি আরবের মাধ্যমে আবার যুদ্ধ নাক গলাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়া। সব মিলিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ।
দরিদ্র দেশ ইয়েমেনের সংকট নিয়ে এত হেভিওয়েট রাষ্ট্রের আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ হলো—এডেন। লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মাঝখানে দেশটির অবস্থান। এই নৌপথ দিয়েই বিশ্বের সিংহভাগ তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে। তাই ইয়েমেন যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তার পক্ষে তেলসম্পদের ওপর খবরদারি করাও সহজ হবে। ঠিক এই কৌশলগত কারণেই ইয়েমেন সবার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান পরিস্থিতি
সম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দখল করে নিয়েছে এডেন শহর। ভূরাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ বিরোধীদের হাতে চলে যাওয়ায় সৌদি আরব কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের সেনা প্রত্যাহারেও সামরিক জোটের মধ্যে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্বাভাবিকভাবেই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এবার দক্ষিণ ইয়েমেনে আরও এলাকা দখলে উৎসাহী হয়ে উঠবে। অন্যদিকে হুতিরা দেশটির উত্তরাঞ্চলে প্রভাবশালী। এখনো সানা থেকেই তাদের হঠাতে পারেনি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাই আশঙ্কা রয়েছে যে, ইয়েমেন হয়তো টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে ইয়েমেন সংকটের সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। কারণ ওই প্রক্রিয়া বছরখানেক ধরে চললেও, তা থেকে ইতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
মাঝখান থেকে চিঁড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ। তাদের আর কত দিন ওই দুর্ভোগ পোহাতে হবে, কে জানে। উলুখাগড়াদের নিয়ে ভাবার মতো সময় যে রাজাদের নেই!
তথ্যসূত্র: বিবিসি, গার্ডিয়ান, ফরেন পলিসি, ডয়চে ভেলে, ফরেন অ্যাফেয়ার্স ও আল জাজিরা