দশকের পর দশক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মাটিতে নিজেরাই পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের মিছিল। এমন মৃত্যুর মিছিলে শরিক হতে হয়েছে জয়নব আল-কুলাকের স্বজনদেরও। একজন নয়, দুজন নয়, ২২ জনকে হারিয়েছেন তিনি।
ফিলিস্তিনি তরুণী জয়নব বলছিলেন, ‘আমার বয়স ২২ বছর, আমি ২২ জনকে হারিয়েছি।’ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় এত স্বজন হারান তিনি। জীবনের সেই করুণ কাহিনি এখন তুলির আঁচড়ে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। চলতি মাসে গাজায় আয়োজিত হয় তাঁর প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শনী।
জয়নব তাঁর মা, একমাত্র বোন, দুই ভাইসহ পরিবারের ২২ সদস্যকে হারিয়েছেন গত বছরের মে মাসে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিযানকালে।
দিনটি ছিল ১৬ মে ২০২১। হঠাৎ ইসরায়েলের একটি যুদ্ধবিমান উড়ে এসে বোমা ফেলে জয়নবদের বাড়ির ওপরে। নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সাজানো-গোছানো বাড়িটা। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েন তাঁর স্বজনেরা। চাপা পড়েন নিজেও। সঙ্গে চাপা পড়ে তাঁর কতশত স্বপ্ন। ১২ ঘণ্টা পর তাঁকে সেখান থেকে বের করে আনতে সক্ষম হন উদ্ধারকর্মীরা।
একসঙ্গে এতজনকে হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠা জয়নবের জন্য কঠিনই ছিল। শোক কাটিয়ে উঠতে গত বছরের বাকি সময়টুকু ছবি এঁকে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন তিনি। ওই চিত্রকর্মগুলো নিয়েই গাজায় ২৪ মে দু দিনের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে মানবাধিকার সংগঠন ‘ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর’ এবং ইউএন উইমেন প্যালেস্টাইন। জয়নবের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে একটি ছোট বইও প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলা কীভাবে তাঁকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সে বিষয়েও লেখা রয়েছে বইটিতে।
১৬ মে ২০২১। হঠাৎ ইসরায়েলের একটি যুদ্ধবিমান উড়ে এসে বোমা ফেলে জয়নবদের বাড়ির ওপরে। নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সাজানো-গোছানো বাড়িটা।
যেদিন বোমা হামলায় নিজেদের বাড়িটা মাটিতে মিশে যায়, সেদিনের ঘটনাবলি জয়নব তাঁর চিত্রকর্মগুলোতে ফুটিয়ে তুলেছেন। হামলার পর থেকে তিনি প্রতিনিয়ত নিজের ভেতর যে দ্বন্দ্ব-লড়াইয়ের সম্মুখীন হন, সেই অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে রংতুলিতে।
প্রদর্শনী চলার সময় জয়নবের সঙ্গে কথা হয় কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিটি চিত্রকর্ম একেকটি মর্মান্তিক মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি। ইসরায়েলি দখলদারির কারণে এসব মুহূর্তকে সঙ্গে নিয়েই আমি বেঁচে আছি।’
জয়নব বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, তাঁর আঁকা ছবিগুলোর মূল উপজীব্য ‘মৃত্যু ও যুদ্ধ’। তিনি চান, যে যন্ত্রণাদায়ক একেকটি মুহূর্ত তিনি পার করে এসেছেন, একজন দর্শক যেন তা অনুধাবন করতে পারেন।
যেমন জয়নব একটি ছবি এঁকেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর ভাইয়ের স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের সময়ে তোলা ছবিকে কেন্দ্র করে। ভাইয়ের ওই সময়ের ছবিটা তাঁর হৃদয়কে দারুণভাবে নাড়া দেয়। আঁকা ছবিতে তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যেখানে দেহবিহীন পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা।
জয়নব বলেন, এই চিত্রকর্মে এই ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছে যে তাঁদের পোশাকই শুধু রয়ে গেছে। তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। চিত্রকর্মটি আঁকতে যে রং ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে চোখের জল আছে।
আরেকটি চিত্রকর্মে নিজের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন জয়নব। এই চিত্রকর্মে নিজেকে মৃত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। চিত্রকর্মটি সম্পর্কে জয়নব বলেন, ‘আমি এটা বলতে চেয়েছি, আমাকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করে আনা মানেই এটা নয় যে আমার ভেতরের ধ্বংসস্তূপও সরে গেছে বা আমি এখন ভালো আছি।’
মূলত ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে ছবি আঁকা শুরু করেন জয়নব। কিন্তু এখনো মাঝেমধ্যেই সেই ট্রমা ফিরে ফিরে আসে। এই প্রদর্শনীর সময় সেই ট্রমা ফিরে এসেছিল। ফলে বাধ্য হয়ে কিছু সময়ের জন্য একা ছিলেন তিনি।
ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জয়নব এখনো তাঁর বাড়িতে যেতে চান না। তাঁর বাড়িতেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
রাজি না হওয়াটা জয়নবের জন্য একেবারে অমূলক নয়। কারণ, তাঁর স্মৃতিতে সেই বোমা হামলার ঘটনা এখনো দগদগে ক্ষতের মতো। তিনি বলেন, ‘ওই হামলার শব্দ ছিল বিকট। এতে আমাদের বাড়ি কেঁপে উঠেছিল। আমার দাদি বলেছিলেন, দেয়াল কাঁপছে। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আবিষ্কার করি।’
তখন জয়নব জানতেন না, তাঁর পরিবারের সদস্যরা মারা গেছেন। এরপর উদ্ধার করে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, স্বজনেরা মারা গেছেন। তাঁদের দাফন করা হয়েছে।
জয়নবের বাবাই মূলত তাঁকে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। ওই বোমা হামলার আগেও জয়নব ছবি আঁকতেন। বাবা বলেন, বোমা হামলার পর একেবারে ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছিলেন জয়নব। তবে বেশ কয়েক দফা চেষ্টার পর তাঁকে ছবি আঁকায় ফেরাতে সক্ষম হন তিনি।
জয়নব আগে ছবি আঁকতেন আনন্দের, রঙিন জীবনের। কিন্তু সেই ছবিই এখন বদলে গেছে। এখন যা আঁকেন, তা সব বিষাদের।
সূত্র: আল-জাজিরা ও রয়টার্স