হামাসে হানিয়ার উত্তরসূরি কে হচ্ছেন
হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া বিমান হামলায় গত বুধবার ভোরে ইরানের রাজধানী তেহরানে নিহত হয়েছেন। এর পর থেকে হানিয়ার উত্তরাধিকার কে হচ্ছেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছে। তালিকায় যে কয়েক ব্যক্তির নাম ওপরের দিকে রয়েছে, খালেদ মেশাল তাঁদের অন্যতম।
৬৮ বছর বয়সী খালেদ ১৯৫৬ সালে পশ্চিম তীরের সিলওয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদাল কাদির মেশাল পেশায় ছিলেন কৃষক। খালেদ স্থানীয় একটি স্কুলে পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ১৯৫৭ সালে খালেদের বাবা কৃষিকাজের জন্য কুয়েতে চলে যান। পাশাপাশি তিনি সেখানে ইমামতিও করতেন।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পরিবারের সঙ্গে খালেদও কুয়েতে পাড়ি জমান। ১৯৭৮ সালে খালেদ কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক করেন।
১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে কুয়েতে বিখ্যাত আবদুল্লাহ আল-সালিম স্কুলে পড়ার সময় খালেদ মুসলিম ব্রাদারহুডের সংস্পর্শে আসেন। পরে কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও গভীর হয়। স্নাতক শেষে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন খালেদ। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি কুয়েতের বিভিন্ন স্কুলে পদার্থবিজ্ঞান পড়ান।
১৯৮৩ সালে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি আরব দেশে রুদ্ধদ্বার একটি আন্তর্জাতিক বৈঠক করে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন (পিএলও)। এতে পশ্চিম তীর, গাজা ও বিভিন্ন আরব দেশের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। সম্মেলনটি হামাসের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে বলে ধরা হয়। খালেদও ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়। খালেদ হামাসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নন। তবে তিনি হামাসের পলিটব্যুরোর শুরুর দিকের সদস্য। ১৯৯৬ সালে তিনি হামাসের পলিটব্যুরোর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
পরের বছর ১৯৯৭ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে খালেদকে হত্যার চেষ্টা করে ইসরায়েল। মোসাদের দুই এজেন্ট ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছিল।
১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আম্মানে অবস্থিত হামাসের কার্যালয়ে ঢোকার সময় দুই এজেন্টের একজন পেছন থেকে এসে খালেদের বাঁ কানের পাশে ইনজেকশন পুশ করে। এতে তিনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন। অবশ্য তখন মৃত্যুর দুয়ার থেকে তিনি ফিরে এসেছিলেন।
তখন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজের প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনিই খালেদকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
খালেদকে বিষ প্রয়োগে হত্যাচেষ্টা করার প্রতিক্রিয়ায় জর্ডানের তৎকালীন বাদশা হোসাইন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। খালেদের চিকিৎসার জন্য তিনি দ্রুত প্রতিষেধক পাঠাতে নেতানিয়াহুর প্রতি অনুরোধ করেন। অন্যথায় ইসরায়েলর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করার হুমকি দেন।
ইসরায়েল প্রতিষেধক পাঠিয়েছিল। হামাসের নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছিল। ওদিকে খালেদের দেহরক্ষীরা ইসরায়েলি এজেন্টদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ব্যর্থ হত্যাচেষ্টার পর খালেদের নাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি লাভের সাত বছরের মাথায় ২০০৪ সালের মার্চে ইসরায়েলের গুপ্তহত্যায় গাজায় নিহত হন হামাসের বৃদ্ধ নেতা শেখ ইয়াসিন। পরের মাসে তাঁর উত্তরসূরি আবদুল আজিজ আল-রান্তিসিকেও হত্যা করে ইসরায়েলের এজেন্টরা। এরপর হামাসের সার্বিক নেতৃত্ব যায় খালেদের হাতে।
একপর্যায়ে আম্মানে হামাসের কার্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। তখন কাতারে চলে যান খালেদ। সেখান থেকে ২০০১ সালে সিরিয়ায় চলে যান তিনি। ২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। সুন্নি মুসলমানরাই এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন। খালেদ বিদ্রোহীদের সমর্থন দেন। হামাস নিজেও সুন্নি মুসলমানদের একটি সংগঠন। কিন্তু কৌশলগত কারণে হামাসের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ইরান, যার নেতারা সবাই শিয়া ধর্মাবলম্বী।
বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়ায় পরের বছর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে খালেদকে দামেস্ক ছাড়তে হয়। একই সঙ্গে ইরানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। কারণ, ইরান আসাদের পক্ষ নিয়ে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। এর পর থেকে কাতারের দোহা ও মিসরের কায়রোতে ভাগাভাগি করে থাকতে শুরু করেন খালেদ।
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়ায় হামাসের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক দুর্বল হওয়ার কথা খালেদ নিজেই রয়টার্সের কাছে স্বীকার করেছেন। কারণ, সংগঠনটি তাঁদের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য অর্থ ও অস্ত্রের জন্য প্রধানত ইরানের ওপর নির্ভরশীল।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর খালেদ বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়টি এখন আবার বিশ্বমঞ্চের কেন্দ্রে চলে এসেছে। চলমান যুদ্ধে হামাসকে সহায়তা দিতে আরব দেশ ও বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন খালেদ।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে হামাসের ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করেছিলেন খালেদ। ১১ বছর বয়সে পশ্চিম তীর থেকে কুয়েতে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম প্রবেশ।
বিদেশ থেকে খালেদের নেতৃত্বকালে হামাস গাজায় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে যায়। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের আইনসভা নির্বাচনে হামাস জয়ী হয়। ২০০৭ সালে সেখানে হামাস ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মধ্যে গৃহযুদ্ধ হয়। এর পর থেকে হামাস উপত্যকাটি শাসন করছে।
এ সময়ে খালেদ ও গাজাভিত্তিক হামাসের নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। কারণ, তিনি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার পক্ষে ছিলেন।
এমন এক পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালে হামাসের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন খালেদ। এরপর তাঁর ডেপুটি ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নির্বাচিত হন। তিনিও দোহা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। প্রয়াত হানিয়া চলমান শান্তি আলোচনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খালেদকে হামাসের পরবর্তী প্রধান করা নিয়ে ইরান আপত্তি করতে পারে। ইরান বরং হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা খলিল আল-হাইয়াকে পরবর্তী প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করতে পারে। ইসমাইল হানিয়ার মতো খলিলও হামাসের দোহা ব্যুরো থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
২০২১ সালে হামাসের প্রবাসী ফিলিস্তিন দপ্তরের প্রধান নির্বাচিত হন খালেদ মেশাল। হামাসের একটা অংশ ও বিদেশের কিছু শক্তি তাঁকেই হামাসের পরবর্তী প্রধান হিসেবে চান।