বন্দী ফিলিস্তিনি নারী সাংবাদিককে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী
শান্তভাবে বসে আছেন লামা খাতার। চোখে–মুখে ক্লান্তির ছাপ, মুখ মলিন, ঠোঁট শুষ্ক। কিন্তু তাঁকে ঘিরে চারপাশের পরিবেশ বেশ স্বস্তির। তিনি নিজেও স্বস্তি পাচ্ছেন।
৪৭ বছর বয়সী এই নারী গত নভেম্বরের শেষ দিকে ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে ষষ্ঠ দফায় যেসব বন্দী ও জিম্মি বিনিময় হয়, লামা তাঁদের একজন। গত ৭ সেপ্টেম্বর হামাসের হামলার পর শত শত ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েল গ্রেপ্তার করে।
লামার কারাগারের থাকার অভিজ্ঞতা তাঁর এক দুর্বিষহ স্মৃতি। পশ্চিম তীরের হেবরনে বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বারবার তাঁকে এক বন্দিশিবির থেকে অন্য বন্দিশিবিরে নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর
বিরুদ্ধে ঠিক কী অভিযোগ বা তাঁর সঙ্গে কী করা হবে, তা তিনি জানতেন না।
লেখক ও সাংবাদিক লামা খাতার ইসরায়েলি দখলদারদের অপরাধ ও সীমা লঙ্ঘনের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তিনি নিজেই সেই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছেন। অপমানিত হয়েছেন।
নোংরা ও সংকীর্ণ
১৩ মাস লামা বন্দিশিবিরে ছিলেন। কিন্তু ৭ সেপ্টেম্বরের পর তাঁর বন্দিদশার চিত্র ‘সংজ্ঞার বাইরে’ চলে যায়। তাঁর হাতকড়ায় প্লাস্টিকের জিপ লাগিয়ে তাঁকে সেনাদের জিপের মেঝেতে ফেলে নিয়ে যাওয়া হয় কিরিয়াত আরবা বসতি ক্যাম্পে। হাতকড়া যতক্ষণ তাঁর হাতে ছিল, তাতে লাগানো প্লাস্টিকের জিপ সারাক্ষণ তাঁর কবজিতে বিঁধছিল।
সেখানে লামাকে জেরা শুরু হয়। প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা তাঁকে নানা ধরনের হুমকি দিয়েছিলেন, এর মধ্যে ধর্ষণের হুমকিও ছিল। লামা বলেন, ‘তাঁরা আমাকে, আমার পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন। এমনকি তাঁরা তাঁকে গাজায় নির্বাসিত করারও হুমকি দিয়েছিলেন। আমাকে বলা হয়েছিল, তিনি একজন যুদ্ধবন্দী, তাই তাঁরা তাঁর সঙ্গে যা খুশি করতে পারেন।’
লামা আরও বলেন, চার দিন পরে তাঁকে হাশারন কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে আরও পাঁচজনের সঙ্গে ছোট্ট একটি কুঠুরিতে আটকে রাখা হয়। অথচ সেই সেলটি বানানো হয়েছে একজনের জন্য।
সেলটির পরিবেশ ‘অত্যন্ত নোংরা’ উল্লেখ করে লামা বলেন, সেলটি পরিষ্কার করার মতো পর্যন্ত পানি দেওয়া হয়নি। দিনে আট ঘণ্টা তাঁদের পানি দেওয়া হতো না। যেহেতু খুব ছোট জায়গা ছিল, তাই তাঁদের ছয়জনকে পালা করে বসতে ও শুতে হতো।
এরপর হাশরন কারাগার থেকে লামাকে নেওয়া হয় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের দামোন কারাগারে। সেখানে তাঁকে বিবস্ত্র করে অপমান করা হয়। সেখানে তিনি অন্য বন্দীদের নির্মমভাবে পেটাতে দেখেছেন।
পরিবারের শূন্যতা ও কারাগারের যন্ত্রণা
প্রশাসনিক বন্দী হিসেবে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত লামা একপর্যায়ে নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন। ভাবছিলেন, তাঁকে ছাড়া কীভাবে সন্তান ও স্বামী চলছে।
ঠিক তখনই হেবরন থেকে আসা এক নারীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে সেই সময়ই ওই নারী গ্রেপ্তার হন। ওই নারী তাঁকে জানান, তাঁর (লামা) স্বামীকেও ৮ নভেম্বর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মানে বাবা–মা ছাড়া তাঁদের পাঁচ সন্তান বাড়িতে। এই অবস্থায় সন্তানেরা কীভাবে আছে, তা ভেবে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন।
কিছুই করার ছিল না এই মায়ের। তারপরও ভেবে অবাক হচ্ছিলেন, যখন তাঁদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছিল, তখন ওই শিশুগুলো কতটাই–না ভয় পাচ্ছিল, বিশেষ করে সাত বছরের ইয়াহা।
লামা বলেন, ‘এর মধ্যে সিন-বেতের (ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা) এক সদস্য আমার কাছে এসে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমার সন্তানেরা এখন বাড়িতে একা।’ তাঁর চোখে–মুখে ছিল আত্মতৃপ্তি।
লামার ২৩ বছর বয়সী মেয়ে বিসান আল–জাজিরাকে বলেন, তাঁকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ছোট ভাইবোনদের ‘বাবা ও মা’ দুজনেরই ভূমিকাই পালন করতে হয়েছে। কারণ, ছোট্ট ছোট্ট তিন ভাইবোন স্কুলের শিক্ষার্থী। এবং তাদের দেখভালের দরকার ছিল।
বিসান বলেন, ‘৭ বছরের ইয়াহ সব সময়ই আমাকে আর বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করত—মা কী খাচ্ছে, মা কী ঠিক আছে, কখন বাড়ি আসবে। আর বাবা আল-ফাখৌরি যখন গ্রেপ্তার হলেন, তখন এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে।’
ওই সময় দামোন কারাগারে নারীদের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছিল, তাতে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কখনো কখনো সামান্য কারণেও তারা নারীদের ওপর খুব কাছ থেকে মরিচের গুঁড়া স্প্রে করত। তারা বন্দীদের নির্জন কারাগারে রাখত। খুব অল্প খাবার দিত, এমনকি ক্যানটিন থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কিনবে, সেই সুযোগও ছিল সীমিত। স্যানিটারি প্যাড কিনতেও বাধা দেওয়া হতো।
শেষমেশ লামাকে নভেম্বরের শেষ দিকে অফার কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে ঠান্ডা সেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে অপেক্ষায় রাখা হয়। ওই সময়টুকুতে তাঁকে কোনো খাবার বা পানি কিছুই দেওয়া হয়নি। ভোরবেলা তিনি মুক্তি পান।
তবে ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে লামাকে সেখানকার ইসরায়েলি কর্মকর্তা ও রক্ষীরা শাসিয়ে যান, হুমকি দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাতে কোনো কিছু প্রকাশ না করে, সেই হুমকি ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দিয়েছেন উল্লেখ করে লামা বলেন, ‘তারা আমাকে বলে দেয়, যেকোনো ধরনের উদ্যাপন নিষিদ্ধ, এমনকি আমার মুক্তিতে যাতে কেউ আমাকে শুভকামনাও না জানায়।’
লামা বলেন, ‘আমি যদি তাদের “নিয়ম” ভঙ্গ করি , তাহলে তারা আমাকে আবার গ্রেপ্তার করবে।’
কিন্তু মুক্ত লামা মোটেও এতে উদ্বিগ্ন ছিলেন না; কারণ, তখন তাঁর চোখের সামনে ভাসছে সন্তানদের মুখ। কারণ, সবাই জানেন একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় হলো সন্তানদের থেকে দূরে থাকা।
গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দখলকৃত পশ্চিম তীর থেকে প্রায় ৬ হাজার ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করেছে। সেই সময় ইসরায়েলি বাহিনী বা বসতি স্থাপনকারীদের পৃথক আক্রমণ ও রাতভর অভিযানে ২৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই সংখ্যা এখন আরও বেড়েছে।
বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে যেসব ফিলিস্তিনি মুক্তি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ইসরায়েলি বাহিনীর দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন। কেউ শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। কেউ বলেছেন, দীর্ঘ সময় তাঁদের নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন, ইসরায়েলি কারা রক্ষীরা তাঁদের হয়রানি ও লাঞ্ছিত করেছেন। কারারক্ষীরা বন্দীদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে রাখতেন। এর মধ্যে রেডিও ছিল। বন্দীরা যাতে বাইরের জগতের কোনো তথ্য না পান, সেই চেষ্টা করতেন।