শরীরে আগুন দেওয়া সেই মার্কিন সেনার নামে ফিলিস্তিনে সড়ক
তিনি ফিলিস্তিনি নন। বাড়িও ফিলিস্তিন থেকে যোজন যোজন দূরে। তারপরও ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ হৃদয় ছুঁয়েছিল তাঁর। প্রতিবাদ জানাতে শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সদস্য অ্যারন বুশনেল। ২৫ বছরের টগবগে সেই তরুণের নামে ফিলিস্তিনের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।
সড়কটি অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেরিকো শহরে। গতকাল রোববার সড়কের নতুন নামফলক উন্মোচন করেন জেরিকোর মেয়র আবদুল করিম সিদর। সেখানে তখন মানুষের জমায়েত। সবার উদ্দেশে মেয়র বলছিলেন, ‘আমরা তাঁকে চিনতাম না। তিনিও আমাদের চিনতেন না। আমাদের মধ্যে কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বন্ধন ছিল না। তাঁর সঙ্গে আমাদের যে বিষয়টি মিলে যায়, তা হলো—স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা, আর (গাজায়) ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।’
অ্যারন বুশনেল গাজায় হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে চরম পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। দিনটি ছিল গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। সামরিক বাহিনীর পোশাকে তিনি হাজির হন ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাসের বাইরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করছিলেন। সেখানেই ঘোষণা দেন, ‘গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে চান না’। এরপর নিজের শরীরে আগুন দেন। এ সময়ও তাঁর আকুল আবেদন ছিল একটাই—‘ফিলিস্তিনের মুক্তি চাই।’ এর পরপরই বুশনেলকে উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তবে বাঁচানো যায়নি।
গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় রক্তক্ষয়ী হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে প্রতিদিনই উপত্যকাটিতে বাড়ছে ফিলিস্তিনিদের লাশের সারি। এখন পর্যন্ত সেখানে ৩১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের এই নৃশংস হামলা যখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের সরকারের সমর্থন পাচ্ছে, তখনই বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন গাজার বাসিন্দারা। প্রাচ্য থেকে সুদূর পাশ্চাত্য—ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে রাজপথে নেমেছেন তাঁরা। এই সাধারণ মানুষের কাতারেই যোগ দিয়েছিলেন বুশনেল।
ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বুশনেল যে আত্মত্যাগ করেছেন, তাকে সংহতির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ হিসেবে দেখছেন জেরিকোর বাসিন্দারা। এমনই একজন শহরটির কাউন্সিল সদস্য আমানি রায়ান। গাজায় বেড়ে ওঠা এই মানুষটি ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য পশ্চিম তীরে এসেছিলেন। আমানি বলেন, ‘তিনি (বুশনেল) নিজের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটিই উৎসর্গ করে দিয়েছেন। গাজার শিশুদের জন্য এই মানুষটি নিজের সব সুযোগ–সুবিধা ত্যাগ করেছেন।’
জেরিকো ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক একটি শহর। সবচেয়ে প্রাচীন যে শহরগুলোতে মানুষের পদচারণ কখনোই থেমে যায়নি, সেগুলোর একটি। এই শহরের দক্ষিণেই অ্যারন বুশনেল সড়কটি। বাসাবাড়ি আর উদ্যান মিলিয়ে এলাকাটি সব সময় জমজমাট থাকে। ঘোড়দৌড়সহ নানা খেলার আয়োজন করা হয়। অ্যারন বুশনেল সড়কটি মাহমুদ দারবিশ সড়কের একটি শাখা। মাহমুদ দারবিশকে জাতীয় কবি হিসেবে মনে করেন ফিলিস্তিনিরা।
জেরিকোর বাসিন্দা আমানি রায়ান বলছিলেন, ‘এখানে অ্যারন বুশনেল আর মাহমুদ দারবিশ একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন। দুজনই ফিলিস্তিনের গল্পের পাতায় শক্তিশালী দুটি নাম।’ জেরিকোর অনেকের মতোই আমানি রায়ানও চান, বুশনেলের পরিবার যেন শহরটি ভ্রমণে আসে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁদের ধন্যবাদ দিতে চাই। ধন্যবাদ দিতে চাই তাঁকে (বুশনেল) লালনপালন করার জন্য, তাঁকে এমন নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করার জন্য।’
এর আগেও ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ব্যক্তিদের নামে পশ্চিম তীরে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন জেরিকোর মেয়র আবদুল করিম সিদর স্মরণ করলেন র্যাচেল কোরির কথা। সে ২০০৩ সালের ঘটনা। ইসরায়েলি সেনারা তখন গাজার বাড়িঘর ধ্বংসের অভিযানে নেমেছিলেন। তাঁদের বাধা দিতে এগিয়ে যান মার্কিন নাগরিক কোরি। একটি বুলডোজারের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। পরে র্যাচেল কোরির নামে রামাল্লার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়।
এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার নামে জেরিকোর একটি চত্বরের নাম দেওয়া হয়েছে। গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে—এমন অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। মেয়র আবদুল করিম সিদর বলেন, ‘শহরের বাসিন্দা—এমনকি দর্শনার্থী যাঁরা আসবেন, তাঁদের সবার নজরে পড়বে এই নামগুলো। সবাই এই মানুষগুলোকে স্মরণ করবেন।’