ইসরায়েলি নৃশংসতা চলছেই

ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন এক স্বজন। কাফনে মোড়ানো তাঁর মরদেহের পাশে ফিলিস্তিনি এক নারীর আহাজারি। প্রিয়জনের মৃত্যুতে শিশুর কান্নাও থামছে না। গতকাল উত্তর গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল চত্বরেছবি: এএফপি

আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান—কোনো কিছু আমলে না নিয়েই ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উপত্যকাটিতে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গতকাল শনিবার থেকে আগের ৪৮ ঘণ্টায়ও ১৩০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এরপরও ইসরায়েল বলছে, হামাসকে নির্মূল করতে তাদের এ হামলা।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে টানা ১৫ মাস গাজায় নির্বিচার হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এরই মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর গত ১৯ জানুয়ারি উপত্যকাটিতে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। এ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে মঙ্গলবার ভোররাতে গাজায় আবার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন উত্তর থেকে দক্ষিণ—উপত্যকাটির সর্বত্র নৃশংস হামলা চলে।

গতকাল গাজায় যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি অভিযান চালিয়েছে স্থল বাহিনী। উত্তর গাজায় ব্যাপক কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। ওই গোলা আঘাত হেনেছে নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরেও। এ ছাড়া গাজা নগরীর পূর্বে তুফা এলাকার একটি বাড়িতে ইসরায়েলের হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এদিন দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেরিকো শহরের কাছে হামলা চালিয়েছেন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা।

উত্তর গাজার তুফা এলাকায় হামলার পর হতাহত ব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়া হয় কাছের আল–আহলি আরব হাসপাতালে। সেখানে স্থানীয় এক সাংবাদিকের ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, দুটি শিশুসহ কয়েকজনকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি শিশুর ছোট্ট শরীর নিথর হয়ে আছে, হাত–পাগুলো একেবারে আড়ষ্ট। ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করেছে আল–জাজিরা।

যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় গত পাঁচ দিনের হামলায় দুই শতাধিক শিশু নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল–ইউনিসেফ। আর গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এ সময়য়ে মোট নিহত হয়েছেন ৬৩৪ ফিলিস্তিনি। সব মিলিয়ে গত ১৭ মাসে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন ৪৯ হাজার ৭৪৭ জন। আর আহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি।

জাতিসংঘের ত্রাণ ও মানবিক সহায়তাসংক্রান্ত সংস্থার (ওসিএইচএ) মুখপাত্র ওলগা চেরেভকোর বলেছেন, গাজায় গত কয়েক দিনের হামলায় ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েল সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ফলে ত্রাণসহায়তা প্রবেশ করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতি সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।

গাজাবাসীর এত দুর্দশার মধ্যেও উপত্যকাটির আরও এলাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, হামাস যদি বাকি জিম্মিদের মুক্তি না দেয়, তবে গাজার কিছু অংশ স্থায়ীভাবে দখল করে নেওয়া হবে। সব জিম্মিকে ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত গাজায় ‘ক্রমবর্ধমান তীব্রতার সঙ্গে’ স্থল অভিযান চলবে।

হিজবুল্লার লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের হামলা

লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর রকেট হামলার পর দক্ষিণ লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠীটির বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলার দাবি করেছে নেতানিয়াহু সরকার। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘সন্ত্রাসীদের কয়েক ডজন লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে’ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

গতকাল ইসরায়েলের হামলায় এক শিশুসহ দুজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরে এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ জানায়, ইসরায়েলের রকেট হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই। ১৪ মাস সংঘাতের পর দুই পক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল, তার প্রতি তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও যুদ্ধবিরতির মধ্যে নিয়মিত লেবাননে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

দোহার হামাদ বিল খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুলতান বারাকাত আল-জাজিরাকে বলেন, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে যত দিন লেবাননে ইসরায়েলি দখলদারি চলবে, তত দিন প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে হিজবুল্লাহ। আর এবার ইসরায়েলের হামলা আগের মতো তীব্র না হলেও, তারা সব সময় বৈরুত সরকারকে চাপের মধ্যে রাখতে চাচ্ছে।

হামাসের টিকে থাকার লড়াই

যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েলের হামলা শুরুর দিন—মঙ্গলবারেই হামাসের সরকারপ্রধান এসাম আদালিস ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাপ্রধান আবু ওয়াতফা নিহত হন। আর যুদ্ধবিরতির আগে ১৫ মাসে প্রায় ২০ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতাও। এ সময়ে সংগঠনটির অস্ত্রের মজুতও কমেছে।

ইসরায়েলের নৃশংসতার মধ্যে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে হামাস। সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, মৃত্যুর আগেও নিয়মিত বৈঠক করেছেন এসাম আদালিস। সরকারে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের বেতন দিয়েছেন এবং ত্রাণ সরবরাহ জারি রাখার জন্য আলোচনা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ইসরায়েলের তীব্র হামলার মুখে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে হামাস।

অস্ত্র ও নিরাপত্তা–সংকটের মুখে যুদ্ধবিরতির আগে কিছু কৌশল হাতে নিয়েছিল হামাস। সরাসরি যুদ্ধের বদলে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালাচ্ছিল তারা। প্রযুক্তিগত নজরদারি এড়াতে বার্তা আদান–প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল মানুষ। এতে সফলতাও এসেছিল। হামাসের গেরিলা হামলায় বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা নিহত হন। হামাস–ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি বলেন, ইসরায়েল যদি আবার গাজার বেশি ভেতরে সেনা পাঠানো শুরু করে, তবে তাদের সঙ্গে লড়াই অনিবার্য হবে এবং ইসরায়েলি সেনারা আবার মৃত্যুর মুখে পড়বেন। প্রসঙ্গত, গাজা অভিযানে প্রায় ৯০০ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন।

তেল আবিবভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মোশে ডায়ান সেন্টারের সাবেক কর্মকর্তা মাইকেল মিলশতেইন বলেন, গত ১৭ মাসে হামাস বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে গাজার সড়কগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখনো তাদের হাতে। ইসরায়েলের হামলার কারণে উপত্যকাটিতে অনেক তরুণ বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁদের যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে হামাস। এ ছাড়া শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাকে হারানোর পরও তারা নতুন কাউকে না কাউকে ওই পদে নিয়ে আসছে। গাজায় হামাসই প্রভাবশালী।