আরব বসন্তের ‘আঁতুড়ঘর’ তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের দুর্দশা

নির্বাচনে জয়ের পর রাজধানী তিউনিসে সমর্থকদের সঙ্গে বিজয় উদ্‌যাপন করছেন প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদছবি: এএফপি

বিরোধীদের ধরপাকড় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগের মধ্যেই গত রোববার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো তিউনিসিয়ায়। উল্লেখ করার মতো কোনো নির্বাচনী প্রচার ও বিতর্ক ছাড়াই প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন। ২০১১ সালের আরব বসন্তের আঁতুড়ঘর হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে তিউনিসিয়া যে কৃতিত্বের দাবি করে আসছিল, এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেখা গেছে, সেই অবস্থান থেকে অনেকটা পেছনে সরে গেছে দেশটি।

তিউনিসিয়ার ভোটারের সংখ্যা ৯০ লাখ। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে দেশটির মাত্র ১১ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি ছিল কম, মাত্র ২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে এ নির্বাচনে। যে ভোট পড়েছে, তার ৯০ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন কাইস সাইদ।

ভোট পড়ার হার এত কম হওয়ায় এটা স্পষ্ট, কাইস সাইদের প্রতি দেশটির মানুষের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কাইস সাইদ। এর পর থেকে তিনি নিজের ইচ্ছামতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাঁর সরকারের হস্তক্ষেপ দিন দিন বাড়ছে।

নথিপত্র নেই, এমন কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ধরপাকড় শুরুর নির্দেশ দেন কাইস সাইদ। তাঁর এ নির্দেশ বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল। কিন্ত এরপরও অবৈধভাবে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আসা ঠেকাতে তিউনিসিয়ার সঙ্গে ১০ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডের একটি চুক্তি করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

বিভিন্ন পথ দিয়ে তিউনিসিয়ায় আসেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠেকাতে কাজ করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর একটি বিশেষায়িত শাখা। বিশেষায়িত ওই শাখার বিরুদ্ধে নারী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওপর যৌন সহিংসতার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন অভিযোগের পরও চুক্তির বিনিময়ে ইইউর কাছ থেকে পাওয়া অর্থ এই বাহিনীকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

তিউনিসিয়ার এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী ছিলেন ১৭ জন। কিন্তু নির্বাচনের আগে ১৪ জন প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করে দেশটির ইনডিপেনডেন্ট হাই অথরিটি ফর ইলেকশনস (আইএসআইই)। নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার ক্ষেত্রে যেসব কারণের কথা বলা হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শেষ পর্যন্ত যে তিনজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন দেশটির সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য আয়াচি জামমেল। ভোটের মাত্র ৫ দিন আগে নথি জালিয়াতির মামলায় তাঁকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির আদালত। কারাবন্দী এই প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, পেয়েছেন ৭ শতাংশ ভোট।

এ নির্বাচনে কোনো প্রচার, মিছিল, বিতর্ক হয়নি। রাস্তায় যেসব পোস্টার সাঁটানো হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই ছিল প্রেসিডেন্টের পক্ষের।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক উপপরিচালক বাসাম খাজা গার্ডিয়ানকে বলেন, তিউনিসিয়ায় এবারের নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ১৪ জুলাই। এর পর থেকে দেশটিতে অন্তত ৯ জন সম্ভাব্য (প্রেসিডেন্ট) প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা, সাজা নয়তো গ্রেপ্তার করার ঘটনা ঘটেছে।

গত মাসের শেষ দিকে তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি প্রস্তাব পাস হয়। তাতে নির্বাচন কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত দেশটির আদালত পাল্টে দেওয়ার যে অধিকার পেতেন, তা কেড়ে নেওয়া হয়। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনজন প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তা বাতিল করে দেন আদালত। এরপরই মূলত কাইস সাইদের দল পার্লামেন্টে ওই প্রস্তাব তুলেছিল।

নির্বাচনের আগে আগে পার্লামেন্টে পাস হওয়া এ বিধানসহ সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলেন কাইস সাইদ। রোববারের নির্বাচনে জয়ী হয়ে এখন তিনি আরও পাঁচ বছরের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কর্মসূচির একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো সারাহ ইয়েরকেস গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘তিউনিসিয়ার এবারের নির্বাচন প্রায় নিশ্চিতভাবেই আরব বিশ্বের একমাত্র গণতান্ত্রিক (শাসনব্যবস্থার) দেশটির গতিপথ যে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে, তারই নজির হতে যাচ্ছে।’

২০১১ সালে গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলী। তিউনিসিয়া থেকে সেই বিক্ষোভ পুরো আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, যা আরব বসন্ত নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরপর অঞ্চলটিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিউনিসিয়াকে সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে। পরপর দুটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশটির সেই সুনাম আরও বেড়েছিল।

সবশেষ ২০১৯ সালে তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে। সেবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন কাইস সাইদ। ২০১১ সালের পর থেকে দেশটির সরকারে ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত দুটি অংশের মতপার্থক্যের কারণে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনী প্রচারণায় আরও শক্তিশালী একটি সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন কাইস সাইদ। রাজনৈতিকভাবে অখ্যাত হলেও গত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কাইস সাইদ। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৭৩ শতাংশ ও দ্বিতীয় ধাপে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার দুই বছরের মাথায় ২০২১ সালে বিরোধী নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্ট ভেঙে দেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন কাইস সাইদ। এরপর ২০২২ সালে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা হয়। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রবর্তন করা হয় একক সরকারব্যবস্থা। এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদের হাতে চলে যায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। কাইস সাইদ ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাচন কমিশনের সাতজন সদস্যকে প্রেসিডেন্টের ডিক্রি জারির মাধ্যমে নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়ে নেন।

কাইস সাইদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধান বিরোধী দল এন্নাহদার এক ডজনের বেশি শীর্ষস্থানীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার এসব নেতার মধ্যে দেশটির সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য সাইদ ফেরজানিও আছেন। ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত বেন আলীর সময়েও তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া দেশটির প্রধান বিরোধী দলের অনেক নেতা এখন বন্দী।

এ প্রসঙ্গে এইচআরডব্লিউর বাসাম খাজা গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘(বিরোধী নেতাদের) এ ধরনের নিপীড়ন ও ধরপাকড়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার অর্থ হলো তিউনিসিয়ার মানুষের সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের যে অধিকার, তা নিয়ে মশকরা করা।’

কাইস সাইদ আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আরও অধঃপতনের মুখে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সারাহ ইয়েরকেস গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ব্যবহার করে তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফেরার পথে কফিনে আরও একটি পেরেক ঠুকে দিয়েছেন কাইস। আর এটা তিনি করেছেন নির্বাচনের বহু আগেই।’