ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিজবুল্লাহর নতুন সামরিক নেতৃত্ব, চলছে গেরিলা হামলা
দক্ষিণ লেবাননে শত্রুপক্ষকে দুর্বল করার কৌশল হাতে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের হামলায় এরই মধ্যে সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা নিহত হয়েছেন। তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্থল ও রকেট হামলা চালাতে নতুন সামরিক নেতৃত্ব গঠন করেছে তারা। হিজবুল্লাহর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানাশোনা আছে, এমন একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
গত মাসে শুরু হওয়া ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংগঠনটির বহু স্থাপনা। তবে হিজবুল্লাহ–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলার পরও সংগঠনটির হাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। নিজেদের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখনো ব্যবহার করেনি তারা। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
সূত্র জানিয়েছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতে নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব সমস্যার মুখে পড়ে। তবে এর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নতুন সামরিক নেতৃত্ব গঠন করা হয়। ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যেও নতুন নেতৃত্ব কাজ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা লড়াই করছেন ও রকেট হামলা চালাচ্ছেন।
হিজবুল্লাহর নতুন নেতৃত্ব গোপনে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির একজন কমান্ডার। তবে সদস্যদের সঙ্গে নতুন নেতারা কীভাবে যোগাযোগ করছেন বা নেতৃত্বে কারা রয়েছেন, সে বিষয়ে কিছুই বলেননি তিনি। নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর হাসেম সাফিয়েদ্দিন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তবে তিনিও পরে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন।
হিজবুল্লাহকে আগে যেমন ভয়ংকর মনে করা হতো, এখনো তেমনই আছে বলে মনে করেন ইসরায়েলভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আলমার বিশ্লেষক আব্রাহাম লেভাইন। তিনি বলেন, এটা সত্য যে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইসরায়েলের মানুষ বা সেনাসদস্যদের ওপর হামলা চালানোর ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা কমে যায়নি।
সুড়ঙ্গে যুদ্ধ
১ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে স্থল হামলা শুরুর ঘোষণা দেয়। বর্তমানে সেখানে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর চারটি ডিভিশন অবস্থান করছে। একেকটি ডিভিশনে এক হাজারের বেশি সেনাসদস্য থাকেন। ইসরায়েল জানিয়েছে, স্থল হামলা শুরুর পর দক্ষিণ লেবানন ও উত্তর ইসরায়েলে তাদের ১২ সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।
দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর সুড়ঙ্গের বিশাল একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আলমা এ নিয়ে ২০২১ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়, ২০০৬ সালে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধের পর এসব সুড়ঙ্গ গড়ে তোলা হয়। সুড়ঙ্গগুলো কয়েক শ কিলোমিটার দীর্ঘ বলে ধারণা ইসরায়েলের।
সুড়ঙ্গগুলো নিয়ে হিজবুল্লাহর একজন কমান্ডার বলেন, দক্ষিণ লেবাননে যুদ্ধের ভিত্তিই হলো এসব সুড়ঙ্গ। সেগুলো গড়ে তুলতে বছরের পর বছর সময় লেগেছে। এখন সুড়ঙ্গগুলো কাজে লাগানোর সময় চলে এসেছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি সেনাদের দখল করা কয়েকটি সুড়ঙ্গের ভিডিও প্রকাশ করা হয়। ৫ অক্টোবর প্রকাশিত এমনই একটি ভিডিওতে টেলিফোন সংযোগসহ মাটির নিচের কয়েকটি কক্ষ দেখা যায়। হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলের গ্যালিলি অঞ্চলে প্রবেশ করতেই ওই সুড়ঙ্গগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। সেগুলো সম্পর্কে ইসরায়েলের পুরোপুরি ধারণা নেই।
গেরিলা হামলা
সূত্র জানিয়ছে, গত সপ্তাহে দক্ষিণ লেবাননের ওদাইসে গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল ইসরায়েলি বাহিনী। এ সময় লুকিয়ে থাকা হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা তাদের ওপর হামলা চালান। হামলায় তাঁরা মাইন ও ‘করনেট’ নামে রাশিয়ার তৈরি ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। একই ধরনের অস্ত্র ২০০৬ সালের যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল হিজবুল্লাহ।
ওই গেরিলা হামলা ২ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে। ইসরায়েলি বাহিনীর ভাষ্যমতে, সেদিন হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াইয়ে ইসরায়েলের পাঁচ সেনা নিহত ও পাঁচজন আহত হন। একই দিনে আলাদা একটি হামলায় নিহত হন আরও দুই ইসরায়েলি সেনা।
গত বছর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ। এতে লেবানন সীমান্তবর্তী উত্তর ইসরায়েল থেকে অনেক বাসিন্দা নিরাপদে সরে গেছেন। তাঁদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টায় রয়েছে ইসরায়েল সরকার। বৈরুতভিত্তিক কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের গবেষক মহানন্দ হেজ বলেন, তিনি আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন ইসরায়েল স্থল হামলা চালাবে। তবে প্রশ্ন হলো, তাদের জন্য হিজবুল্লাহ এটা কতটা কঠিন করে তুলবে?
দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর বড় সমর্থন রয়েছে। এ অঞ্চলে ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে লড়তেই মূলত গত শতকের আশির দশকে ইরানের সমর্থনে গড়ে উঠেছিল সংগঠনটি। কিংস কলেজ লন্ডনের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আন্দ্রিয়েস ক্রেইগ বলেন, স্থলে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করা হিজবুল্লাহর জন্য বেশ সহজ। এমন যুদ্ধের জন্যই তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। আর স্থল যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই তাদের বেশির ভাগ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।