গাজায় ধ্বংসস্তূপ এখন ফিলিস্তিনিদের বড় চিন্তা

জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী, গাজায় ৪ কোটি ২০ লাখ টনের বেশি ভগ্নাবশেষ সৃষ্টি হয়েছে।

গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে লোকজনকে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েল। জাবালিয়া এলাকা থেকে শিশুটিকে হুইলচেয়ারে করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। আজ গাজা সিটিতেছবি: এএফপি

গাজার খান ইউনিসে দোতলা বাড়ি ছিল ১১ বছর বয়সী মোহাম্মদদের। সেই বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়ির ভাঙা ছাদের টুকরাগুলো জড়ো করছে সে ও তার বাবা জিহাদ সামালি। এই টুকরাগুলো দিয়ে তারা নতুন ঘর তৈরি করবে না। মোহাম্মদের ভাইয়ের কবরে এগুলো দিয়ে একটা সমাধি তৈরি করে রাখবে।

তাদের মতো অনেকেই এভাবে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে ছোট ছোট তাঁবু তৈরি করে থাকছেন। অল্প অল্প করে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন।

নির্মাণকর্মী জিহাদ বলেন, গত এপ্রিলে ইসরায়েলি হামলায় তাঁদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখান থেকে তাঁরা ধাতব খণ্ড কাটার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, বাড়ি তৈরির জন্য নয়, এখন কবরে রাখার জন্য ভাঙা পাথর জোগাড় করতে হচ্ছে।

জিহাদ আরও বলেন, ‘এক দুর্দশা থেকে আমরা আরেক দুর্দশায় পড়েছি।’

জিহাদের জন্য এই কাজ করা কঠিন এবং একই সঙ্গে কষ্টকর। গত মার্চ মাসে তাঁর আরেক ছেলে ইসমাইল ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন।

গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় যে পরিমাণ ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তা সরানোর একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা এটি। জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী, গাজায় ৪ কোটি ২০ লাখ টনের বেশি ভগ্নাবশেষ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে এখনো ক্ষতিগ্রস্ত ও কোনোরকম দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ভবন রয়েছে। অনেক ভবন বিধ্বস্ত হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

  • ২০০৮ সাল থেকে এক বছরে হামলায় গাজায় যে ধ্বংসাবশেষ ছিল, এবার তার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি ধ্বংসাবশেষ।

  • ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ধ্বংসাবশেষের নিচে এখনো অনেক মরদেহ চাপা পড়ে রয়েছে।

২০০৮ সাল থেকে এক বছর আগের হামলা শুরুর সময় গাজায় ভবনের যে ধ্বংসাবশেষ ছিল, তার চেয়ে এখন ১৪ গুণ বেশি ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।

জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বলেছেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই ধ্বংসাবশেষ নিয়ে করণীয় বিষয়ে গাজা কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ মাসেই জাতিসংঘের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংস্থা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খান ইউনিস ও দেইর আল-বালাহ অঞ্চলে সড়কে থাকা ধ্বংসাবশেষ সরানোর প্রকল্প শুরুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির গাজা কার্যালয়ের প্রধান আলেসান্দ্রো ম্র্যাকিক বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। এটা অনেক বড় কর্মসূচি হতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আমরা যা শুরু করেছি, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, হামাসের যোদ্ধারা সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গেছে। তাদের যেখানে দেখা যাবে, সেখানে হামলা করা হবে। তবে তারা বেসামরিক লোকজনকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।

ধ্বংসস্তূপ নিয়ে ইসরায়েলে সামরিক বাহিনীর শাখা সিওজিএটি বলেছে, তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করার চেষ্টা করছে এবং জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করবে।

ম্র্যাকিক আরও বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা দারুণ হবে, তবে এ নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা এখনো ঠিক করা হয়নি।

গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। এর আগে হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা ও ২৫০ জনকে জিম্মি করে। এর পর থেকে গত এক বছরে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে ইসরায়েলি হামলায় একসময়ের ব৵স্ত সড়কে এখন ধ্বংসস্তূপে ভরে উঠেছে। সেখানে চলাচল করার মতো অবস্থা নেই।

খান ইউনিসে নিজের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ কিছুটা সরিয়ে সেখানে তাঁবু তৈরি করে থাকছেন ট্যাক্সিচালক আবু শাবাব। তিনি বলেন, ‘এখানে কে আসবে আর আমাদের হয়ে এ ধ্বংসস্তূপ সরাবে। কেউ আসবে না। তাই এ কাজ আমরা নিজেরাই করছি।’

গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর আগে সেখানে ১ লাখ ৬৩ হাজারের মতো ভবন ছিল। কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে পাওয়া জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এসব ভবনের সব কটি ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এসব ভবনের এক-তৃতীয়াংশ বহুতল ভবন ছিল।

এর আগে ২০১৪ সালে গাজায় সাত সপ্তাহের লড়াইয়ের পর ইউএনডিপি সেখানে ৩০ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ সরিয়েছিল। ম্র্যাকিকের ধারণা, এক কোটি টন বর্জ্য পরিষ্কারে ২৮ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়। সে হিসাবে এখন যুদ্ধ বন্ধ হলে গাজার ধ্বংসাবশেষ সরাতেই ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি খরচ হবে।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ধ্বংসাবশেষের নিচে এখনো অনেক মরদেহ চাপা পড়ে রয়েছে। তাদের হিসাবে এ সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে। আন্তর্জাতিক রেডক্রস বলছে, ফিলিস্তিনে এখন বড় ধরনের হুমকি রয়েছে। এ ছাড়া সেখানকার ধ্বংসাবশেষ বড় ধরনের আঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি বলেছে, আনুমানিক ২৩ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ দূষিত, যা থেকে নানা রোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, গত বছরে গাজায় তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের শিকার ১০ লাখ মানুষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র বিসমা আকবর বলেছেন, গাজায় ধুলা উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, একই সঙ্গে এটি পানি ও মাটিকে দূষিত করে ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করতে পারে।