কথা ছিল বিদেশে ছবি আঁকার, আছেন স্কুলের বারান্দায়

নিজের আঁকা চিত্রকর্ম দিয়েই ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ সম্পর্কে বিশ্বকে বার্তা দিতে চান রাফাহ ক্রসিংয়ে আটকে থাকা শিল্পী মোহাম্মদ আলমাদৌনছবি: এক্স থেকে নেওয়া

মোহাম্মদ আলমাদৌন একজন চিত্রশিল্পী। ছবি আঁকা নিয়ে তাঁর কিছু পরিকল্পনাও ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে গত মাসে বাড়ি থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে ছবি আঁকায় ব্যস্ত সময় কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু বড় সুযোগ পেয়েও তা আর হয়নি আলমাদৌনের ভাগ্যে।

৪৪ বছর বয়সী আলমাদৌন গাজা উপত্যকার একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট। মাসব্যাপী ছবি আঁকার একটি কর্মশালায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। আয়ারল্যান্ডের বারেন কলেজ অব আর্ট থেকে এই আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সেখানে আরও শিল্পীদের আসার কথা ছিল। নিজেদের ধারণা, পরিকল্পনা আদান–প্রদানের সুযোগ ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা করেও যেতে পারেননি আলমাদৌন। যুদ্ধের কারণে রাফাহ ক্রসিংয়ে আটকে আছেন তিনি।

আয়ারল্যান্ডের উদ্দেশে আলমাদৌনের নির্ধারিত ফ্লাইট ছিল গত ৭ অক্টোবর। একই দিনে হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালান। শুরু হয় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত। এ ঘটনায় আটকা পড়েন তিনি।

আরও পড়ুন

এই শিল্পী এখন মিসরের সীমান্তবর্তী রাফাহ ক্রসিংয়ে আটকা। এখান থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ—যুদ্ধ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা।

আয়ারল্যান্ড ভ্রমণের জন্য গত সেপ্টেম্বরে ভিসা পেয়েছিলেন আলমাদৌন। আর ৪৫ দিন ধরে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। মুক্তির অপেক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত গুনছেন তিনি। তবে এই ক্রসিংয়ে বিদেশি নাগরিক ও গুরুতর আহত ফিলিস্তিনিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

আল–জাজিরাকে আলমাদৌন বলেন, ‘আমি ভীষণ ক্লান্ত। আমরা বর্ণনাহীন মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি।’

চেষ্টা করছে আয়ারল্যান্ড

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার সমালোচনাকারী কয়েকটি পশ্চিমা দেশের মধ্যে আয়ারল্যান্ড অন্যতম। ফিলিস্তিনি অধিকারের সমর্থনে সংহতি আছে দেশটির।

বারেন কলেজ অব আর্টের ভর্তিবিষয়ক পরিচালক লিসা নিউম্যান বলেছেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই শিল্পীকে কয়েক সপ্তাহ ধরে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। মিসর, ইসরায়েল, আয়ারল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দূতাবাসের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
লিসা বলেন, ‘আমরা আইরিশ ভিসার মাধ্যমে তাঁকে সাহায্য করার জন্য আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবকিছু করছি।’ তিনি বলেন, আইরিশ কলেজে তাঁর থাকার অর্থ ‘দুই দেশের মধ্যে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি’ বিনিময়।

আলমাদৌন বলেন, ‘[আইরিশ] জনগণ, আইরিশ সরকার, বস্তুগত ও নৈতিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রদর্শনকারীদের মধ্যে প্রথম।’

কষ্টের জীবন

শিল্পী আলমাদৌন উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবির থেকে এসেছেন। গত ৯ অক্টোবর রাফাহ ক্রসিংয়ের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। ইসরায়েলির বোমা হামলার কারণে দক্ষিণে যাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে গাড়ি ভাড়াও করেছিলেন তিনি।

পরিবার থেকে এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন আলমাদৌন। চারপাশে কেবল বোমা আর বোমা। পরিবারের কাছেও যেতে পারছেন না। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই শিল্পীর পর্তুগালেও আরেকটি চিত্রকর্মের কর্মশালায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল। সেখানেও যেতে পারেননি। বোমা হামলায় ২৫ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা তাঁর স্টুডিও ধ্বংস হয়ে গেছে।

ছবির জগৎ ছেড়ে আলমাদৌন এখন আছেন রাফাহ ক্রসিংয়ে জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে। এই স্কুলের সিঁড়ি, বারান্দা এমনকি শৌচাগারেও হাজার হাজার মানুষ ঘুমিয়ে আছে। এখানে খাবার ও পানি দুষ্প্রাপ্য এবং ব্যয়বহুল। এমন জীবন কখনো কল্পনা করেননি তিনি।

আরও পড়ুন

শিল্পকর্মের মাধ্যমে দিতে চান বার্তা

তবে আলমাদৌন এখনো আশা ছাড়েননি। তিনি এখনো স্বপ্ন দেখেন দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর। শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব করার।

এই শিল্পী বলেন, ‘আমি শিল্পী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি শিল্পের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বেদনাদায়ক ঘটনা, বহু বছর ধরে চলা নিপীড়ন, অবিচার, হত্যা, বাস্তুচ্যুতি এবং অবরোধ থেকে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ সম্পর্কে বিশ্বকে বার্তা দেওয়ার জন্য।’

আলমাদৌন বলেন, শিল্পীরা দেশের রাষ্ট্রদূত। তাঁর আশা, গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধে তিনি কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন। সাহসী ভূমিকা রাখতে পারবেন।
শিল্পী আলমাদৌন বলেন, ‘আমার প্রত্যাশা, অন্যায় অবরোধ তুলে নেওয়া হবে এবং [আমাদের] জনগণ তাদের ভূমির ওপর সার্বভৌমত্ব পাবে, ভ্রমণের স্বাধীনতা থাকবে... এবং ফিলিস্তিনের জীবন ও সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসার বার্তা দেবে।’

আরও পড়ুন