বাশারের সময়ে সাংবাদিকতার ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা জানালেন বিবিসির সাংবাদিক

বিবিসির সাংবাদিক লিনা সিনজাব। সিরিয়ার এই নারী সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনামলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর তিনি নিজ দেশে ফেরেন। বাশার আল-আসাদের আমলে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়া, হুমকি পাওয়া, দেশত্যাগে বাধ্য হওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন।

বিবিসির সাংবাদিক লিনা সিনজাব। সিরিয়ার এই নারী সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর নিজ দেশে ফেরেনছবি: লিনা সিনজাবের ফেসবুক থেকে নেওয়া

১১ বছর আগে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ছেড়েছিলেন বিবিসির সাংবাদিক লিনা সিনজাব। তখন তিনি জানতেন না, আর কখনো নিজ দেশে ফিরতে পারবেন কি না।

তখন পুরো শহরে যুদ্ধের দামামা বাজছিল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল সহিংসতা। সিরিয়ার তৎকালীন বাশার আল-আসাদের সরকার দেশটির গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীদের দমনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন।

পরিস্থিতি এমন ছিল, যেকোনো মুহূর্তে কাউকে রাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলা হতে পারে।

সিরিয়ায় ২০১১ সালে বিক্ষোভ শুরু হয়। শুরু থেকেই দেশের ভেতরে অবস্থান করে সাংবাদিকতা করছিলেন বিবিসির লিনা সিনজাব।

বিক্ষোভ নিয়ে লিনা সিনজাবের পাঠানো প্রতিবেদন বিবিসিতে প্রচারিত হচ্ছিল। তাঁর প্রতিবেদনে গুলি, হত্যা, গুম, বিমান হামলা, এমনকি ব্যারেল বোমা ব্যবহারের খবরাখবর উঠে আসছিল। তাঁর প্রতিবেদনের মাধ্যমে মানুষ সিরিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে।

তবে ধীরে ধীরে আশা হারিয়ে ফেলেন লিনা সিনজাব। একপর্যায়ে তাঁর নিজেকে কেমন অসাড় মনে হতে থাকে।

লিনা সিনজাবকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বাশার আল-আসাদের প্রশাসন তাঁর চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে, প্রতিকূল হয়ে যায় যে ২০১৩ সালে লিনা সিনজাবকে দেশ ছাড়তে হয়।

গত এক দশক লিনা সিনজাব আশা-নিরাশার চরম দোলাচলের মধ্যে ছিলেন। বিদেশে বসে নিজের দেশকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে দেখেন তিনি।

মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ, আটক, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, লাখো মানুষের পালিয়ে যাওয়া, শরণার্থী জীবন কাটাতে বাধ্য হওয়া—এমন বহুবিধ ঘটনা ঘটতে দেখেছেন লিনা সিনজাব।

অন্যান্য অনেক সিরিয়ানের মতো লিনা সিনজাবেরও মনে হয়েছিল, বাকি বিশ্ব হয়তো সিরীয়দের কথা ভুলে গেছে। সুরঙ্গের শেষ প্রান্তে কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি।

টানা ২৪ বছর শাসন করার পর পতন ঘটেছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের
ছবি: এএফপি

এরপর সম্প্রতি সিরিয়ার মানুষ আবার রাস্তায় নেমে আসে। বাশার আল-আসাদের পতনের দাবিতে সোচ্চার হয়। কিন্তু তখনো লিনা সিনজাব ভাবতে পারেননি যে তারা আদতে সফল হবে। বিশেষ করে যখন বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল রাশিয়া ও ইরান।

কিন্তু গত রোববার চোখের পলকে সব বদলে যায়।

গত সপ্তাহে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বসে বাশার আল-আসাদ-বিরোধী যোদ্ধাদের হাতে সিরিয়ার আলেপ্পো ও হামা শহরের পতনের প্রতিবেদন করছিলেন লিনা সিনজাব। কিন্তু তখনো তিনি ভাবতে পারেননি, আসলেই তাঁর দেশে কোনো পরিবর্তন আসবে।

লিনা সিনজাব ভেবেছিলেন, সিরিয়া হয়তো দুই ভাগ হয়ে যাবে। রাজধানী দামেস্ক আর উপকূলীয় শহরগুলো বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

গত শনিবার মধ্যরাতের পর পরিস্থিতি আচমকা বদলে যায়। ভোররাত চারটা নাগাদ ঘোষণা করা হয়, বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

লিনা সিনজাব এখন বাশার আল-আসাদের পতনের কথা লিখছেন। অথচ এই তিনিই তখন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে আসলেই এমন ঘটনা ঘটে গেছে।

বাশার আল-আসাদের পতনের ঘোষণা আসার পর লিনা সিনজাব সিরিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গোপন পুলিশ সংস্থাগুলোর একটির (প্যালেস্টাইন ব্র্যাঞ্চ নামে পরিচিত) কাছ থেকে দেশে প্রবেশের অনুমতিপত্র পাওয়ার চেষ্টা করেন। সিরিয়ার বিক্ষোভ নিয়ে করা প্রতিবেদনের কারণে এই সংস্থার কাছে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল।

২০১১ সালে সিরিয়ায় বিক্ষোভ শুরুর প্রথম সপ্তাহেই লিনা সিনজাবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই স্মৃতি তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি।

সারি বেঁধে দাঁড়ানো লোকজনকে মারধর করা, মেঝেতে তাজা রক্ত ছড়িয়ে থাকা, নির্যাতনের কারণে চিৎকার করা—এমন নানা ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল লিনা সিনজাবের।

বাশার আল-আসাদ সরকারের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা লিনা সিনজাবের মুখ চেপে ধরেছিলেন। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘আর একটা কথা বললে কেটে ফেলব।’

গত রোববারই সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে লিনা সিনজাব সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, সেখানে আর বাশার আল-আসাদ সরকারের এই গোপন পুলিশ সংস্থার কেউ নেই। না নিরাপত্তারক্ষী, না তদন্তকারী—কেউই নেই। অথচ তিনি যখন গত জানুয়ারিতে সবশেষ সিরিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন, তখনো তাঁকে তাদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল।

আরও পড়ুন

সে সময় লিনা সিনজাবকে হুমকি দিয়েছিলেন এক তদন্তকারী। লিনা সিনজাবের ভাষ্যে, ‘তিনি আমাকে বলেছিলেন, সাততলা সমান মাটির নিচে পুঁতে ফেলবেন। কেউ জানতেও পারবে না।’

গত রোববার লিনা সিনজাব অবাক হয়ে ভাবছিলেন, এই হুমকিদাতা কর্মকর্তা এখন কোথায়। হাজার হাজার মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা, হুমকি দেওয়ার বিষয় নিয়ে তিনি এখন কী ভাবছেন? কিংবা বাশার আল-আসাদের কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া মানুষদের নিয়ে তিনি কী ভাবছেন?

সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসে টেলিকমিউনিকেশন ভবনের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছেন বিদ্রোহীরা। ৮ ডিসেম্বর, হোমস, সিরিয়া
ছবি: এএফপি

গ্রেপ্তার হওয়ার ভীতি ছাড়াই লিনা সিনজাব সীমান্ত পার হন। নিজ দেশে প্রবেশ করেন। এবার সিরিয়ায় ঢুকে তিনি যখন বাশার আল-আসাদের হাত থেকে মুক্ত দামেস্কে বসে বিবিসির জন্য প্রতিবেদন করছিলেন, তখন তাঁর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে একটিবারের জন্যও ভয় লাগেনি।

দামেস্কের আকাশে এখন খুশির আমেজ। তবে যে বিদ্রোহী যোদ্ধারা সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ আছে।

তা ছাড়া এই বিদ্রোহী যোদ্ধারা সিরিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান।

আরও পড়ুন

বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) যোদ্ধারা এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা দিচ্ছেন। তবে ইতিমধ্যে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে লুটপাট সংঘটিত হয়েছে। কারাগার থেকে বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যাঁরা বাশার আল-আসাদের আমলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা গত রোববারের পর থেকে লিনা সিনজাবের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন। তাঁরা দেশ ফিরবেন। তাঁর মনে হয়, সবাই ফিরে আসতে চান।

বাশার আল-আসাদের পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সঙ্গে উল্লাসে মাতেন সাধারণ মানুষ। ৮ ডিসেম্বর, দামেস্কের উমায়াদ স্কয়ার
ছবি: এএফপি

২০১৩ সালে লিনা সিনজাব যখন দেশ ছেড়েছিলেন, তখনই দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে থাকা তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট ধ্বংস করে ফেলা হয়। তখন কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেখানে তাঁর বসবাস নিষিদ্ধ করেছিল কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় কর্মকর্তারা অ্যাপার্টমেন্টের দেয়াল ও সিলিং ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিলেন।

আরও পড়ুন

হাজারো ডলার ঘুষ দিয়ে গত মাসে লিনা সিনজাব তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা ফিরে পেতে সক্ষম হন। এখন এই অ্যাপার্টমেন্ট পুননির্মাণে তাঁর বেশ খানিকটা সময় লাগবে। তবে তিনি তা করবেন।

অ্যাপার্টমেন্টটি আবার যখন বসবাসের উপযোগী হবে, তত দিনে সিরিয়া সবার ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে বলেই বিশ্বাস লিনা সিনজাবের।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন