সাদ্দামের পতনে উচ্ছ্বসিত আমের তখন বোঝেননি তছনছ হয়ে যাবে বাকিটা জীবন
‘আমি পাগলের মতো নাচছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না, সাদ্দাম হোসেন আর ক্ষমতায় নেই। মনে হচ্ছিল, আমি যেন খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া এক পাখি’—কথাগুলো বলছিলেন আদেল আমের নামের এক ব্যক্তি। ২০০৩ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেন সরকারের পতনের পর তাঁর অনুভূতি ছিল এমনই। শুধু তা–ই নয়, খুশিতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভোজের আয়োজনও করেছিলেন তিনি।
তবে এই আনন্দ ফিকে হতে বেশি সময় নেয়নি। আমের জানতেন না গত দুই দশকে সাদ্দামের ছড়ির ইশারায় তাঁকে যতটা না দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তার চেয়েও বড় কিছুর মুখে পড়তে চলেছেন তিনি। শুরু হতে চলেছে রক্তমাখা নতুন এক সংঘাত, যাতে পরিবারের সদস্যদের হারাতে হবে তাঁকে, তছনছ হয়ে যাবে বাকিটা জীবন।
আমেরের বয়স এখন ৬৩ বছর। ২০০৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ইরাকে অভিযান শুরু করেছিল, তখন তাঁর বয়স ৪৩। এরও বহু আগে আমেরের দুর্দশার গল্পের শুরু। তিনি ইরাকের সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। তবে গত শতকের আশির দশকে ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।
ইরাক–কুয়েত যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেন একটি আদেশে বলেছিলেন, কেউ সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে গেলে তাঁদের কানের একাংশ কেটে নেওয়া হবে। কপালে খোদাই করা দেওয়া হবে কাটা চিহ্ন।
সে সময়ের কথা মনে করতে গিয়ে চোখের পানি সামলে রাখতে পারছিলেন না আমের। তিনি বললেন, ‘মৃত্যু সব সময় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। সব সময় চোখের সামনে আমার বন্ধুদের মৃত্যু দেখতাম। তাঁদের অনেকে ইরানের ছোড়া গোলার আঘাতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। এসব দেখতে দেখতে আমি হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম।’
পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে একটি ছবি দেখালেন আমের। ছবিটি যুদ্ধক্ষেত্রে আমের ও তাঁর সহযোদ্ধাদের। ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় যখন সেটি তোলা হয়েছিল, তখন আমেরের বয়স মাত্র ২০। দাবি করা হয়, এই যুদ্ধে ১০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ছবির আমের ছিলেন তরুণ। এখন তাঁর চামড়ায় ভাজ পড়েছে, দাড়ি সাদা। জীবনে সংগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত। আমের বললেন, ‘আমি নিজেকে বললাম, এবার আমার সেনাবাহিনী ছেড়ে পালানোর সময় হয়েছে। জানতাম, কখনো ধরা পড়লে আমাকে মেরে ফেলা হবে। তবে সেই সময় বেঁচে থাকাটা ছিল জরুরি। আর আমি তাই করেছিলাম। এখন যে বেঁচে আছি ওই সিদ্ধান্তের জন্যই।’
পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যুর শোক পালনের জন্য আমের যেখানে তাঁবু খাটিয়েছিলেন, ঠিক সেখানেই ২০০৩ সালে সাদ্দামের পতন উদযাপনে ভোজের আয়োজন করেছিলেন তিনি।
আমের থাকতেন বাগদাদের কাছে একটি গ্রামে। সেনাবাহিনী থেকে পালানোর পর ওই গ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে চলে যান তিনি। বসবাস শুরু করেন এক স্বজনের একটি বাগানে। এরপরও ধরা পড়ার দুশ্চিন্তা তাঁর মাথা থেকে যায়নি। তাই দাড়ি বড় রাখা শুরু করেন। একই সঙ্গে কাজ শুরু করেন কৃষক হিসেবে।
নতুন বিপদ
১৯৯০–৯১ সালে আরেকটি বড় বিপদে পড়েন আমের। সে সময় প্রতিবেশী দেশ কুয়েত আক্রমণ করেছিল সাদ্দামের বাহিনী। সাদ্দামের ওই কর্মকাণ্ড ইরাককে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করে ফেলেছিল। ওই যুদ্ধে ইরাকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট। আর দেশটির ঘাড়ে এক দশকের বেশি সময় ধরে চেপেছিল জাতিসংঘের নানা নিষেধাজ্ঞা।
এই যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেন একটি আদেশে বলেছিলেন, কেউ সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে গেলে তাঁর কানের একাংশ কেটে নেওয়া হবে। কপালে খোদাই করে দেওয়া হবে কাটা চিহ্ন। এরপরও সেনাবাহিনীতে ফিরে যাননি আমের। এ কারণে প্রতিবেশী ও সেনাবাহিনীর সাবেক সহকর্মীরা তাঁকে একপ্রকার ঘৃণা করতেন। তবে কেউ তাঁকে ধরিয়ে দেননি। কারণ, তাঁরা জানতেন ধরিয়ে দিলে আমেরকে মেরে ফেলা হতে পারে।
সব মিলিয়ে সে সময় খুবই ভেঙে পড়েছিলেন আমের। বললেন, ‘আমি সারা জীবন অনেক ভুগেছি। অনেক সময় মনে হতো জীবনটা শেষ করে দিই। তারপরই নিজেকে বলতাম, আশা যতই কম হোক না কেন সুদিন আসবে।’
২০০৩ সালে সাদ্দামের শাসন যখন শেষ হলো, তখন বাড়িতে বিশাল ভোজের আয়োজন করেছিলেন আমের। ভেবেছিলেন, মার্কিন সেনারা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন, আর হয়তো পালিয়ে বেড়াতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তাঁর সেনা কর্মকর্তারাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা আর অর্থনৈতিক উন্নতির। ঠিক বিপরীত চিত্র ছিল সাদ্দামের আমলে। তখন নির্দোষ মানুষকে নির্যাতন–হত্যা করা হতো। অপচয় করা হতো তেল বেঁচে আয় করা শত শত কোটি ডলার।
জীবনের শেষভাগে এসে আমের এখনো একরোখা, সুযোগ পেলেই ইরাক ছেড়ে চলে যাবেন তিনি।
তবে সাদ্দামের পতনের পর ইরাকিদের জন্য আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছিল। এর পরপরই সন্ত্রাসী সংগঠন আল–কায়েদা ইরাকজুড়ে সহিংসতা শুরু করে। চলতে থাকে একের পর এক বোমা হামলা ও শিরোশ্ছেদ। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যে চলে নৃশংস এক গৃহযুদ্ধ। সবকিছু এতটাই ভয়াবহ হয়ে পড়ে যে নদীতে মানুষের লাশ ভাসতেও দেখা যেত।
সে সময় লাখ লাখ ইরাকবাসীর মতো আমেরের জীবন আবারও থমকে যায়। শিয়া ও সুন্নি বিদ্রোহীদের তৎপরতায় সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হতো তাঁদের। ইরাকে অবস্থান করা মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে লড়তে থাকা এই বিদ্রোহীরা সাধারণ ইরাকিদের জন্যও নতুন এক যন্ত্রণা হয়ে ওঠে।
প্রিয়জনের খোঁজে
২০০৪ সালের অক্টোবরে আল–কায়েদা সংশ্লিষ্ট সুন্নি বিদ্রোহীরা আমেরের বাবা, ভাই ও চাচাতো ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। কারণ, তাঁরা শিয়া। তিনজনকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা পরিবারের কেউ জানতেন না। আমের বলেন, ‘আমার বাবা, ভাই ও চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে, তা চিন্তা করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আবারও ভয়ভীতি ঘাড়ে নিয়ে দিন কাটানোর জন্য তৈরি ছিলাম না আমি।’
এরপর প্রায় এক বছর কেটে যায়। আমের জানতেন না, তাঁর পরিবারের সদস্যরা বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। মাঝেমধ্যে বাগদাদের মর্গে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতেন। কারণ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতায় নিহত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের মরদেহ সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো।
পরে একদিন পুলিশ আমেরের পরিবারকে মর্গে যেতে বলে। তারা জানায়, কাছেই একটি ডোবা থেকে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সেদিনের স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে আমের বলেন, মর্গের পুরো ভবনটিতে সারি সারি লাশ রাখা ছিল। একটি হাতঘড়ি দেখে তিনি চাচাতো ভাইয়ের লাশ চিনতে পারেন। পরদিন লাশগুলো দাফন করা হয়। ভাগ্যের পরিহাস, তিনজনের মৃত্যুর শোক পালনের জন্য আমের যেখানে তাঁবু খাটিয়েছিলেন, ঠিক সেখানেই ২০০৩ সালে সাদ্দামের পতন উদ্যাপনে ভোজের আয়োজন করেছিলেন।
আবার শুরু হয় আমেরের পলাতক জীবন। স্ত্রী ও তিন মেয়ের জন্য খাবার কেনা ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতেন না তিনি। ২০১০ সালে একটি মার্কিন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে চাকরি পান। তবে তিন বছর পর এই চাকরিই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইরান–সমর্থিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে আটক হন তিনি। এরপর তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়ে, হাড়–দাঁত ভেঙে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়।
আমের বললেন, ‘তারা বলেছিল, আমি মার্কিন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারব না। কারণ, এতে আমি গুপ্তচর হয়ে যাব। এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। নিজেকে বললাম, সাদ্দামের সময়েও এতটা ভুগতে হয়নি, পরিবারের সদস্যদের হারাতে হয়নি, নির্যাতন ও অপমানের শিকার হতে হয়নি, যেমন একটা ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখার জন্য এখন হচ্ছে।’
আবার সেই ‘নরকে’ ফেরা
যা–ই হোক, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রাণভয়ে আমেরকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। পরে ২০১৫ সালে সিদ্ধান্ত নেন, তুরস্কে পালিয়ে যাবেন। সে অনুযায়ী পাঁচ হাজার ডলার দিয়ে নকল পাসপোর্ট বানিয়ে গ্রিসে পাড়ি দেন তিনি। তবে দেশটির একটি বিমানবন্দরে ধরা পড়ে যেতে হয়ে কারাগারে। এক সপ্তাহ কারাগারে কাটানোর পর আমেরকে তুরস্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমের বলেন, ‘দেশকে নিয়ে আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ইরাকে থাকাটা আমার জন্য নরকের মতো ছিল। তাই আমি জীবন দিয়ে হলেও দেশ থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
২০১৬ সালে তুরস্কে একটি বাস আটক করে দেশটির পুলিশ। ওই বাসে ১০ ইরাকির মধ্যে ছিলেন আমের। সাগর পাড়ি দিয়ে আবার গ্রিসে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছিলেন তিনি। এর জেরে এক মাস পরে তাঁকে ইরাকে ফেরত পাঠানো হয়। তখন থেকেই ইরাকে আছেন আমের। কখন আবার শিয়া বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়বেন, এই ভয়ে থাকেন সব সময়।
জীবনের শেষভাগে এসে আমের এখনো একরোখা, সুযোগ পেলেই ইরাক ছেড়ে চলে যাবেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সাদ্দামের সময় আমি পালিয়ে ছিলাম, এখনো পালিয়ে আছি। মার্কিন অভিযানের আগে একজন সাদ্দাম ছিল। আজ তাঁর মতো অনেক সাদ্দাম রয়েছে।’