ইসরায়েলের হামলা সত্ত্বেও অটুট হিজবুল্লাহর সুড়ঙ্গ ও যোগাযোগব্যবস্থা
নমনীয় কাঠামোর চেইন অব কমান্ড, বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ও গত এক বছরে ক্ষেপণাস্ত্র ও অস্ত্রের বিশাল অস্ত্রাগার গড়ে তোলার কারণে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের হামলা সামলে উঠতে পারছে। গোষ্ঠীটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত তিনটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের নিশানা করা হয়েছে। তা ছাড়া পেজার ও ওয়াকি–টকি বিস্ফোরণেও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন।
গত শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর অভিজাত রাদওয়ান বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্ব দেওয়া ইব্রাহিম আকিল নিহত হন। সোমবার বৈরুতে ইসরায়েলের হামলায় ৫৬০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে ৫০ শিশুও ছিল বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
রোববার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান হার্জি হালেভি দাবি করেছেন, আকিলের মৃত্যু হিজবুল্লাহকে নাড়া দিয়েছে। তাঁর দাবি, হামলায় হিজবুল্লাহর হাজার হাজার রকেট ও শেল ধ্বংস হয়েছে।
তবে হিজবুল্লাহর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত দুটি সূত্র জানিয়েছে, গোষ্ঠীটি দ্রুতই হামলায় নিহত আকিল ও অন্য জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের দায়িত্ব প্রতিস্থাপন করেছে। হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়েদ হাসান নাসরাল্লাহ গত ১ আগস্টের একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, যখনই কোনো নেতাকে হত্যা করা হয়, তখন দলটি দ্রুত শূন্যস্থান পূরণ করে।
হিজবুল্লাহর একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, যোগাযোগ ডিভাইসে হামলায় দেড় হাজার যোদ্ধা আহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছেন বা তাঁদের অনেকের হাত উড়ে গেছে।
এটি একটি বড় ধাক্কা হলেও হিজবুল্লাহর শক্তির একটি ভগ্নাংশই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একটি প্রতিবেদনে গোষ্ঠীটির যোদ্ধার সংখ্যা ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বলে উল্লেখ করা হলেও নাসরাল্লাহর দাবি, দলটিতে এক লাখ যোদ্ধা রয়েছেন।
গত বছরের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মিত্র হামাসের সমর্থনে ইসরায়েলে নানা সময় ছোট আকারে হামলা করেছে হিজবুল্লাহ। তিনটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানায়, তখন থেকে লেবাননের দক্ষিণের ফ্রন্টলাইন এলাকায় হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের পুনরায় মোতায়েন করা হয়েছে। এসব যোদ্ধার অনেকে এসেছেন সিরিয়া থেকে।
হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চাইছে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের আভাস পেয়ে গোষ্ঠীটি দ্রুতগতিতে অনেক রকেট জড়ো করেছে বলেও জানিয়েছে রয়টার্সের সূত্রগুলো।
হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক ও অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ ইরান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন দেশে ইরানের মিত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী এই হিজবুল্লাহ। তাদের অনেক অস্ত্রই ইরানি। কিছু অস্ত্র রাশিয়া বা চীনা মডেলের।
রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা সূত্রগুলো নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। তারা হিজবুল্লাহর হাতে নতুন আসা অস্ত্রগুলো সম্পর্কে বা কোথা থেকে কেনা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
নিজেদের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে হিজবুল্লাহর গণমাধ্যম কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো উত্তর পায়নি রয়টার্স।
কিংস কলেজ লন্ডনের স্কুল অব সিকিউরিটি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেন, গত সপ্তাহের হামলায় হিজবুল্লাহর কার্যক্রম ব্যাহত হলেও নেটওয়ার্কভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো এটিকে একটি অত্যন্ত স্থিতিশীল শক্তিতে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, ‘সংখ্যা ও প্রযুক্তি বিবেচনায় নয়; বরং স্থিতিশীলতা বিবেচনায় ইসরায়েল যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে।’
শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র
চলতি সপ্তাহে লেবাননে ইসরায়েলের হামলা বেড়েছে। মঙ্গলবার ইসরায়েল হিজবুল্লাহর আরেক শীর্ষ কমান্ডার ইব্রাহিম কুবাইসিকে হত্যা করেছে। তারপরও হিজবুল্লাহ সামরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে। এত হামলা সত্ত্বেও ইসরায়েলের গভীরে শত শত রকেট ছুড়েছে তারা।
গতকাল বুধবার হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিবের কাছে একটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা ঘাঁটি লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তেল আবিবে একটি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি বিমান বাধা দেওয়ায় সতর্কীকরণ সাইরেন বেজে উঠেছিল।
হিজবুল্লাহর সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটগুলোর মধ্যে কোনটি ছোড়া হয়েছে, তা এখনো জানায়নি গোষ্ঠীটি। হিজবুল্লাহর কাছে ইরান নির্মিত ফাতেহ-১১০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার রেঞ্জ ২৫০-৩০০ কিলোমিটার। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ২০১৮ সালের একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, হিজবুল্লাহর ফাতেহ-১১০–এর ৪৫০-৫০০ কেজি ওয়ারহেড রয়েছে।
এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা দাবি করেছেন, পেজার ও ওয়াকি–টকি বিস্ফোরিত হওয়ার পরও হিজবুল্লাহর রকেট হামলা চালাতে সক্ষম হওয়াটাই প্রমাণ করে যে গ্রুপটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখেও চেইন অব কমান্ড বজায় রেখে কাজ করতে পারছে।
ফিক্সড লাইন টেলিফোন নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে। অনেক যোদ্ধা পেজারের পুরোনো মডেল বহন করছিলেন, ফলে গত সপ্তাহের আক্রমণে তাঁদেরও কোনো ক্ষতি হয়নি।
রয়টার্স এ তথ্য আলাদাভাবে যাচাই করতে পারেনি। বেশির ভাগ পেজার বিস্ফোরিত হয়েছে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে, যা মূল ফ্রন্টলাইন থেকে অনেক দূরে।
এর আগে ইসরায়েলের হামলায় বেশ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হওয়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিজেদের যোদ্ধাদের মুঠোফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল হিজবুল্লাহ। মূলত এরপরই তারা পেজার ব্যবহার বাড়িয়েছিল।
রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেলেও সীমান্তের কাছে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ছোট কিন্তু স্বাধীন গ্রুপে কাজ করার জন্য ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে হিজবুল্লাহ। তারা স্বাধীনভাবেই দীর্ঘ মেয়াদে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে ২০০৬ সালে সর্বশেষ যুদ্ধ হয়েছিল। তখনো ইসরায়েলের হামলার মুখে গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তের গ্রামগুলোতে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন।
মাটির নিচে ক্ষেপণাস্ত্র
দুটি সূত্র জানিয়েছে, হিজবুল্লাহ বেশ ভালোভাবেই তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। রোববার দক্ষিণ লেবাননের এমন এলাকা থেকে রকেট ছোড়া হয়েছিল, যেখানে তার কিছুক্ষণ আগেই ইসরায়েল হামলা চালিয়েছিল।
হিজবুল্লাহর একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার রয়েছে বলে মনে করা হয়। গত মাসে প্রকাশিত একটি ফুটেজে দেখা যায়, হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা রকেট লঞ্চার নিয়ে টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রাক চালাচ্ছেন। রোববার ছোড়া রকেটগুলো ভূগর্ভ থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল কি না, সেটি অবশ্য রয়টার্সের সূত্র জানাতে পারেনি।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট দাবি করেছেন, সোমবারের হামলায় হিজবুল্লাহর হাজার হাজার রকেট ও যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ১০০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম ওয়ারহেডসহ রকেট, স্বল্পপাল্লার রকেট ও বিস্ফোরক ইউএভি সোমবারের আঘাতে ধ্বংস হয়েছে।
তবে ইসরায়েলের এ দাবির সত্যতাও রয়টার্স আলাদাভাবে যাচাই করতে পারেনি।
মার্কিন কংগ্রেসের এক প্রতিবেদন অনুসারে হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারে প্রায় দেড় লাখ রকেট রয়েছে। সবচেয়ে শক্তিশালী ও দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মাটির নিচেই রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।