‘আল্লাহকে ডাকছিলাম, এখনই নয়, দয়া করো, হাসপাতালে যেতে দাও’
প্রতিদিন সকালে আলা আল-নিমার ছয় মাসের মেয়ে নিমাহকে গোসল করাতে জেগে ওঠেন। কারণ, কয়েক মাস ধরে সেখানে পানির সংকট। তাই খুব হিসাব করে পানি খরচ করেন। এই পানি আনতে হয় গাজা সিটির উত্তরাঞ্চলে শেখ রাডন এলাকায় যেখানে পানি বিতরণ হয়, সেখান থেকে। আলা ও তাঁর পরিবারের যত কষ্টই হোক, তিনি ঠিক করেছেন মেয়েকে প্রতিদিন গোসল করাবেনই।
৩৪ বছর বয়সী এই মা বলেন, জীবনের এই কঠিন সময়ে মলমের কাজ করে মেয়ের হাসি। এই মেয়ের যেভাবে জন্ম হয়েছে, তা কোনো দিনই চাননি আলা। তিনি জানান, নিমাহর জন্ম হয় সড়কে।
১১ বারের বেশিবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে
গত অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ছন্নছাড়া জীবন যাপন করতে হচ্ছে আলার পরিবারকে। আলা ও তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ সাত ও পাঁচ বছরের দুই সন্তানকে নিয়ে এখান থেকে ওখানে ছুটেই চলেছেন।
গত অক্টোবরে গাজা সিটির পার্শ্ববর্তী জেইতুন এলাকায় যখন হামলা হয়, তখর তাঁরা প্রথম এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই নেন। এরপর প্রতিবেশীর বাড়িতে। এখান থেকে ওখানে করতে করতে ক্লান্ত আলা জানান, এখন পর্যন্ত ১১ বারের বেশিবার ঘর ছাড়তে হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী লোকজনকে দক্ষিণ সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও তাঁর পরিবার উত্তরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আলা বলেন, ‘আমরা দেখলাম, আসলে কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়।’
একদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আলা বলেন, তাঁরা যে ভবনে ছিলেন, সেই ভবন ইসরায়েলি ট্যাংক ঘিরে গুলি করতে শুরু করে। কিন্তু এই হামলার মধ্যে তিনি, তাঁর দুই ছেলে ও আরও প্রায় ২৫ মানুষ অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
তখন ছিল শীতের মাঝামাঝি সময়। আলা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই অবস্থায় তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে পূর্ব দিকে ওল্ড সিটির উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন। এভাবে চার ঘণ্টা হেঁটেছিলেন। তাঁর স্বামী ওই সময় অসুস্থ শাশুড়ির পাশে ছিলেন। একপর্যায়ে তাঁরা একটি মসজিদের কাছে দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যতক্ষণ না তাঁদের ভবনটি নিরাপদ হয়।
কেউ কি আছেন
আলা মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন অনাগত সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই যাতে এই যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু আলার যখন প্রসব বেদনা শুরু হয়, তখন তিনি নিজেকে বারবার বোঝাচ্ছিলেন, এখনই প্রসব হবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে।
কনকনে শীতের রাত তখন ১০টা। আশপাশে ইসরায়েলি বোমা পড়ছে। এর মধ্যেই তাঁর স্বামী গাড়ি আনতে বের হন। আর তিনি বাড়ির কাছেই থাকা নিজের মা ও বোনকে ফোন দিয়ে আসতে বলেন। এরপর আলা রাস্তায় অপেক্ষা করতে থাকেন। ওই সময় পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাঁর প্রসব বেদনা। এদিকে জ্বালানিসংকটের কারণে এবং অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় সেই সময় গাড়ি পাচ্ছিলেন না আবদুল্লাহ। আর যোগাযোগ নেটওয়ার্কও এত দুর্বল ছিল যে কোনো অ্যাম্বুলেন্সও ডাকা যাচ্ছিল না।
আলা সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে সাহায্যের আর্তি জানাচ্ছিলেন। আল্লাহকে ডেকে বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ এখনই নয়। দয়া করো। আমাকে হাসপাতালে যেতে দাও।’ কারণ তাঁর ভয় ছিল শিশুটিকে নিয়ে।
এরপর যতক্ষণে তাঁর স্বামী ফিরে আসে, ততক্ষণে আলা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর মা ও বোনও এসে এ অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে যান। তাঁরা দৌড়ে আলার কাছে যান। আবদুল্লাহ নবজাতকের মাথা ধরে রেখেছিলেন। আর নবজাতকের নাভির সঙ্গে থাকা নাড়ি কাটার জন্য কাঁচি চেয়ে চিৎকার করছিলেন। তখন সেখানে ছিলেন আলার নিজের ভাই ও ভাই-সম্পর্কীয় কাছের এক স্বজন। তিনিই কাঁচিটি এনে দিয়েছিলেন।
এরপর আবদুল্লাহ একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মাতৃসদন হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু কয়েক মিটার যেতই গাড়িটি থেমে যায়। কারণ, জ্বালানি ফুরিয়ে গিয়েছিল।
আলা বলেন, পুরো রাস্তা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমার সেই আত্মীয় ভাইটি মেয়েকে কোলে নিয়ে নিজের কোট দিয়ে জড়িয়ে নেয়, যাতে ঠান্ডা না লাগে। এরপর দ্রুত সে আমাদের আগে আগে হাঁটতে থাকে। সে তার মুঠোফোনের ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে পথ দেখাচ্ছিল।’
আলা হাঁটছিল ঠিকই, কিন্তু তখনো তাঁর রক্তপাত হচ্ছিল। আর তাঁর পাশে মা ও বোন কাঁদছিলেন। আলা বলেন, ‘আমার মা সড়কে হাঁটছিলেন আর চিৎকার করে বলছিলেন, কেউ কি আছেন? কোনো গাড়ি কি আছে? দয়া করে কেউ কি আমাদের সাহায্য করবেন। আমাদের সঙ্গে সদ্যোজাত একটি শিশু রয়েছে। এই মাত্র তার জন্ম হয়েছে। কিন্তু কোনো দিক থেকে সাড়া মেলেনি।’
এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর একটি মিনিবাস পেয়েছিলেন তাঁরা। সেটি তাঁদের হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। আলা বলেন, গাড়ি পাওয়ার পর আমরা আনন্দে ও ভয়ে কাঁদছিলাম।
এদিকে তাঁরা পৌঁছানোর আগেই আলার স্বামী ও ভাই হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে সব শুনে চিকিৎসক আগে থেকেই হাসপাতালের দরজায় অপেক্ষা করছিলেন। আলা বলেন, ‘আমরা পৌঁছাতেই চিকিৎসক সঙ্গে সঙ্গে আমাকে প্রসূতি ওয়ার্ডে নিয়ে যান।’
সুস্থ শিশু ও এক চামচ হালুয়া
পরদিন তাঁর ঘুম ভাঙলে চিকিৎসক তাঁকে জানান, মেয়ে ভালো আছে। এটা শোনার পর তাঁর আনন্দ ছিল সীমাহীন। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আল্লাহ আমার সঙ্গে ছিলেন।’
এই আনন্দের সময়টুকুতে আরও একটি মুধর স্মৃতির অবতারণা করেন আলা। বলেন, সেই সময় একটি তাজা কমলার রস তাকে খেতে দিয়েছিলেন তাঁর খালাতো বোন। সেই কমলা তিনি কাছের কোনো গাছ থেকে পেরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
আলা বলেন, ‘যুদ্ধকালে এটি আমার প্রথম ও শেষ তাজা ফলের রস খাওয়া।’ এরপর তাঁর সঙ্গে থাকে প্রসূতিকালীন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যাগটিতে খুঁজে পান একটি হালুয়ার ছোট্ট বাক্স। সেটি তাঁর স্বামী রেখেছিলেন। এরপর সেখান থেকে এক চামচ হালুয়া খাওয়ার আগে তিনি লম্বা করে শ্বাস নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘কারণ, যুদ্ধের মধ্যে হালুয়ার স্বাদ কেমন হতে পারে, তা ভুলে গিয়েছিলাম।’
মেয়ে হওয়ার পর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, নিমাহ ভালো আছে। এই সময়ে মায়েদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু খাদ্যসংকটের কারণে নিজের খাবার ঠিকমতো না হলেও মেয়ের বিষয়ে বেশ যত্নবান আলা। নিমাহর হাসি আর আ-উ পরিবারের দৃশ্যপট যেন পাল্টে দিয়েছে।
লাখো পরিবারের মতো আলার পরিবারও এই যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের লোকজন খেয়ে-না খেয়ে দিন পার করছেন। শুধু যে খাওয়ার কষ্ট তা নয়, গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত একটি ভবনের কাছে পাওয়া গিয়েছিল আলার বড় ভাইয়ের মরদেহ।
আলা বলেন, ‘ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে আমার সন্তানটির জন্ম। সে বাঁচবে কি না, সেটি ছিল বড় প্রশ্ন। কিন্তু সেদিন থেকে আমি আর আশা হারাইনি।’