হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে কি সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রায় ১০ মাস হতে চলল। গাজায় নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এর মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা ওই অঞ্চল ও আশপাশের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
ইসরায়েল ও ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে ৯ মাস ধরে আন্তসীমান্তে গোলা বিনিময় হচ্ছে। এই সংঘাত আরও তীব্র হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিলে তা গাজার বিপর্যয়কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সংঘাতে অংশ নিতে পারে ইরাক ও ইয়েমেনের মিলিশিয়ারাও। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। যুদ্ধ বাধলে তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র। সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে ইরান।
মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ কল্পনার চেয়েও মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
লেবাননের প্রাচীন শহর টায়ার। সেখানে এ বছর গ্রীষ্মের বিস্ফোরণের শব্দ সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। কারণ, শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরের সীমান্তে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলর মধ্যে পাল্টপাল্টি গোলাবর্ষণ চলছে কয়েক মাস ধরে।
‘আরেকটি দিন, আরেকটি বোমা’—এমনটাই বলছিলেন ৪৯ বছর বয়সী রোনাল্ড। দেশের বাইরে থাকেন এই লেবানিজ। ছুটিতে তিনি বাড়িতে এসেছেন।
রোনাল্ডের বন্ধু ৩৯ বছর বয়সী মুস্তাফা বলেন, ‘কয়েক মাসে আমরা কীভাবে যেন এ পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তবে শিশুরা এখনো কিছুটা আতঙ্কিত।’
সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে দক্ষিণ লেবাননসহ টায়ার শহর হতে যাচ্ছে গোলাবারুদ নিক্ষেপের প্রধান কেন্দ্র। দক্ষিণ লেবাননসহ এ শহর হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি।
মুস্তাফা বলেন, ‘উভয় পক্ষই বলছে, তারা যুদ্ধ চায় না। কিন্তু আমরা এখন একটি ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।’
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এতে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। হামাস যোদ্ধারা ২৫১ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসেন।
এ ঘটনার পরদিনই সংঘাতে জড়ায় হিজবুল্লাহ। তখন থেকেই লেবানন থেকে ইসরায়েলে গোলা নিক্ষেপ করছে সংগঠনটি। শিয়া ইসলামিক সশস্ত্র গোষ্ঠীটি বলছে, তারা গাজার সমর্থনে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
হিজবুল্লাহ একটি রাজনৈতিক দলও। লেবাননে দলটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ হামাসের মতোই হিজবুল্লাহকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে দেখে।
তবে হামাসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী গোলাবারুদ আছে হিজবুল্লাহর, যা ইসরায়েলকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলতে পারে। হিজবুল্লাহর কাছে আধুনিক প্রযুক্তির দেড় লাখের বেশি রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যা নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।
‘হিজবুল্লাহ’ কথাটার অর্থ আল্লাহর দল। অনেক দেশের চেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্র আছে সংগঠনটির। তাদের সমর্থন দিয়ে আসছে ইরান। দেশটি ইসরায়েলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। ইহুদি রাষ্ট্রটির শত্রুদের প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে ইরান।
ইসরায়েল ও লেবানন সীমান্তে সংঘাত আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কয়েক হাজার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, সৌদি আরবসহ অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের জরুরি ভিত্তিতে লেবানন ছাড়তে বলেছে। দেশটিতে সব ধরনের ভ্রমণ পরিহার করতে বলেছে যুক্তরাজ্য। উভয় পক্ষই এখনো সীমান্তের কাছে সামরিক লক্ষবস্তুগুলোয় হামলা চালাচ্ছে।
তবে লেবানিজরা বলছেন, ‘আমরা আবাসিক এলাকাগুলোয় ধ্বংসযজ্ঞ দেখছি। মাঠের পর মাঠ পুড়ছে। অনেক বাড়িঘর ধসে গেছে। বাসিন্দারা আতঙ্কে অন্যত্র চলে যাওয়ায় অনেক গ্রাম খালি হয়ে গেছে।’
ইটের জবাবে পাটকেল নিক্ষেপের কারণে এরই মধ্যে হাজারও মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। লেবাননে ৯০ হাজারের বেশি এবং ইসরায়েলে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন।
এই সংঘাতে ইসরায়েলের আঘাত খুব ভালোভাবেই প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে লেবানন। তবে বড় মূল্য দিতে হয়েছে লেবানন ও এর জনগণকে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি লেবানিজ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে হিজবুল্লাহ যোদ্ধার সংখ্যা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে ইসরায়েলের সরকার জানায়, দেশটির ১৬০ জন এ সংঘাতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই সেনাসদস্য।
গত অক্টোবরের পর থেকে দক্ষিণ লেবাননের বাতাসে কিছু একটা ছড়াচ্ছে ইসরালয়েল। দেশটির সামরিক বাহিনী ওপর থেকে দমবন্ধ করা সাদা ফসফোরাসের গুঁড়া ফেলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, রাসায়নিকটি অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠে। এটি মানুষের ত্বক ও কাপড়ে লেগে থাকে। রাসায়নিকটি হাড় পর্যন্ত পুড়িয়ে দিতে পারে।
আল বুস্তানসহ দক্ষিণ লেবাননের অনেক ঘনবসতিতে সাদা ফসফরাসের ব্যবহার হয়েছে বলে যাচাই করে সত্যতা পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটি বলছে, জনবহুল এলাকায় ইসরায়েল বেআইনিভাবে সাদা ফসফরাস ব্যবহার করছে।
তবে এ দাবি নাকচ করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলছে, ধোঁয়ার দেয়াল তৈরি করতেই সাদা ফসফরাসের শেল ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট কোনো প্রত্যাশা নিয়ে ব্যাপক ঘনবসতি এলাকায় এসব শেল ব্যবহার করা হয়নি।
হিজবুল্লাহর সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কমান্ডার মোহাম্মাদ নামেহ নাসের। তিনি ২০০৬ সাল ও তার আগে ইসরায়েলে যুদ্ধ করেন। সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন এই হিজবুল্লাহ নেতা। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান পরিচালনা করেন। গত ৩ জুলাই ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে।
লেবাননে সরকারব্যবস্থা বেশ টালমাটাল অবস্থায়। সেখানকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ প্রকট। সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত দেশটির জনগণ। অনেক লেবানিজই এখন ক্লান্ত। সর্বশেষ যে জিনিসটি তাঁরা চান, তা হলো আরেকটি যুদ্ধ।