ইসরায়েলি গোয়েন্দার ফোন, ‘বোমা মারা হবে, ২ ঘণ্টা সময় দিলাম’
মাহমুদ শাহিনের মুঠোফোনে কলটা এসেছিল সকাল সাড়ে ছয়টায়। সেদিন ১৯ অক্টোবর, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অব্যাহত বোমাবর্ষণের ১২তম দিন। মাহমুদের বাসা উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে আল-জাহরা এলাকায়। তখনো ওই এলাকায় তেমন একটা হামলা শুরু করেনি ইসরায়েলি বাহিনী।
সেদিন সকালে বাসার বাইরে ব্যাপক শোরগোল শুনতে পান মাহমুদ। লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন। রাস্তায় একজন মাহমুদকে বলেন, ‘আপনাকে পালাতে হবে। তারা আবাসিক ভবনগুলোয় বোমাবর্ষণ করবে।’ এ কথা শুনে মাহমুদ যখন নিরাপদ জায়গার দিকে এগোনো শুরু করলেন, তখনই তাঁর ফোনটি বেজে উঠল।
ফোনকলটি এসেছিল অচেনা নম্বর থেকে। মাহমুদের কথায়, সেটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ফোনকল। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একজন বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমি আপনাকে ফোন করছি।’ এক ঘণ্টার বেশি সময় কথা হয়েছিল দুজনের।
গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি নিজের নাম আবু খালেদ বলে জানিয়েছিলেন। নিখুঁত আরবিতে কথা বলেছিলেন তিনি। মাহমুদ বলেন, ‘ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, তাঁরা তিনটি ভবনে বোমা ফেলতে চান। আমাদের আশপাশের এলাকাগুলো থেকে সরে যেতে হবে।’ মাহমুদ যে ভবনে থাকেন, সেটি হামলার ঝুঁকিতে ছিল না। তবে ফোনে পাওয়া নির্দেশমতো স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদে সরানোর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল তাঁকে।
৪০ বছর বয়সী মাহমুদ দন্তচিকিৎসক। ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে তিনি ফোন না কাটার জন্য বলেন। দুজনের কথা চলতে থাকে। মাহমুদের ভাষ্যমতে, তিনি জানেন না ওই কাজের জন্য কেন তাঁকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তবে লোকজনকে রক্ষায় যতটা সম্ভব করেছিলেন তিনি। পরে দেখেছিলেন ইসরায়েলের বোমার আঘাতে নিজের এলাকা তছনছ হতে।
মাহমুদ প্রথমে মনে করেছিলেন, ফোনকলটি ভুয়া ছিল। আশপাশের অনেকেই একই কথা বলেছিলেন। ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর ফেসবুকে এমন ভুয়া ফোনকলের কথা শোনা যাচ্ছিল।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এতে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচারে টানা বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। চলছে স্থল অভিযানও। এতে এখন পর্যন্ত গাজায় ১০ হাজার ৫৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেশির ভাগই নারী ও শিশু। হামলায় আহত হয়েছেন ২৬ হাজার ৪৭৫ জন।
গাজার কোনো স্থানে হামলা চালানোর আগে কখনো কখনো সেখানকার বাসিন্দাদের ফোনকলের মাধ্যমে সতর্ক করছে ইসরায়েলি বাহিনী। এমন কল পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাহমুদ একজন। বিষয়টি যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে বিবিসিও। আল-জাহরা এলাকায় অনেক বাসিন্দাই জানিয়েছেন, ১৯ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনীর কাছ থেকে ফোন পেয়েছিলেন মাহমুদ। তবে ওই ফোনকলে কী কথা হয়েছিল, তা নিশ্চিত হতে পারে বিবিসি।
‘আমরা এমন কিছু দেখতে পাই, যা আপনারা পান না’
মাহমুদ প্রথমে মনে করেছিলেন, ফোনকলটি ভুয়া ছিল। আশপাশের অনেকেই একই কথা বলেছিলেন। ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর ফেসবুকে এমন ভুয়া ফোনকলের কথা শোনা যাচ্ছিল। মাহমুদ ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বলেছিলেন, এই সতর্কবার্তা সত্য কি না, তা প্রমাণের জন্য বোমা ফেলে দেখাতে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বোমা আঘাত হানে।
মাহমুদ বুঝতে পারলেন, ফোনকলটি সত্য। তিনি ফোনে ওই ব্যক্তিকে বলেন, ‘মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়ার সময় বোমা মেরে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।’ মাহমুদকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, এমনটি করা হবে না। পরে মাহমুদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁদের এলাকাতেই কেন হামলা চালানো হচ্ছে। জবাবে বলা হয়েছিল, ‘আমরা এমন কিছু দেখতে পাই, যা আপনারা পান না।’
লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পর মাহমুদকে ফোনে বলা হলো এখন বোমাবর্ষণ শুরু হবে। এর পরপরই আকাশে একটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দেখা যায়। বোমার আঘাতে তাঁদের চোখের সামনে ধ্বংস হয় তিনটি আবাসিক ভবন। এরপর ফোনে মাহমুদকে বলা হলো, ‘আমাদের কাজ শেষ হয়েছে। আপনারা এখন ফিরে যেতে পারেন।’
সেদিন সকালে আল-জাহরা এলাকা থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, তিনটি আবাসিক ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিমান হামলার পর হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন আল-জাহরার বাসিন্দারা। ওই এলাকার একটি ফেসবুক গ্রুপে সকাল সাড়ে আটটার দিকে পোস্ট করা হয়, তিনটি ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আবার ফোন, আবার ধ্বংসযজ্ঞ
১৯ অক্টোবরেই রাতের ঘটনা। বাসায় সবে এশার নামাজ শেষ করেছেন মাহমুদ। দেখতে পেলেন ব্যক্তিগত একটি নম্বর থেকে একটি মিসড কল এসেছে। অজানা আশঙ্কায় আবার তাঁর বুক কেঁপে উঠেছিল। ভয় হয়েছিল, আবার কি বোমা হামলা চালানো হবে? এবার কি তাঁর বাসাই ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তু?
কিছুক্ষণ পর আবার ফোন বেজে উঠেছিল। এবার অপর প্রান্তে ছিলেন ভিন্ন এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে দাউদ নামে পরিচয় দিয়েছিলেন। মাহমুদ বলেন, ওই ব্যক্তি প্রথমে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন, হামাসের সমালোচনা করেন। এরপর জানান, সে রাতে গাজায় আবার দুটি ভবনে হামলা হবে। মাহমুদকে আবার লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে হবে।
১৯ অক্টোবরেই রাতের ঘটনা। বাসায় সবে এশার নামাজ শেষ করেছেন মাহমুদ। দেখতে পেলেন ব্যক্তিগত একটি নম্বর থেকে একটি মিসড কল এসেছে। অজানা আশঙ্কায় আবার তাঁর বুক কেঁপে উঠেছিল।
মাহমুদের ভাষায়, ‘তিনি আমাকে বললেন, “আমরা চাই, আপনি লোকজনকে এলাকা ছেড়ে যেতে বলেন।” আমি বলেছিলাম, এ কাজে আমার সময় দরকার।’ তবে কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ইসরায়েলের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন এসেছিল। মাহমুদকে বলা হয়েছিল, দুটি ভবন নয়, সেখানকার আরও কয়েকটি ভবনে হামলা চালানো হবে। ফলে হামলা হতে যাওয়া ভবনের সংখ্যা বেড়ে ২০টির বেশিতে দাঁড়ায়। সেখানে শত শত বাসা ছিল।
তখন ফোনকলে থাকা ব্যক্তিকে মাহমুদ বলেছিলেন, ‘ওই ভবনগুলো নিয়ে আগে সতর্কতা দেওয়া হয়নি। তাই সেখান থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়নি। আমাদের অন্তত সকাল পর্যন্ত সময় দিন। এই রাতে লোকজন কোথায় যাবে?’ জবাবে ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘আমাদের হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর আমরা দুই ঘণ্টার মধ্যে সব কটি ভবনে হামলা চালাব।’
এরপর মাহমুদ ভবনগুলো থেকে মানুষ সরিয়ে নেওয়ার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। সেখানে দেখা দেয় বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতি। লোকজনের চিৎকার আর শিশুদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। ভিড়ের মধ্যে অনেকেই শিশুসন্তানদের হারিয়ে ফেলেন। পুরো সময়টাতে মাহমুদ ফোনকলে ছিলেন। অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, হামলা যেন দেরিতে চালানো হয়।
সেদিন রাতে শেষ পর্যন্ত ফোনকলের সতর্কতা অনুযায়ী ইসরায়েলের হামলা হয়েছিল। হামলার পরের ধ্বংসস্তূপের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সেদিন রাত সোয়া ৯টার দিকে ফেসবুকে একটি পোস্ট করে বলা হয়, ‘আল-জাহরার ভবনগুলোয় মাত্র বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের ক্ষমা করুক।’
১৯ অক্টোবরই শেষ নয়। এরপরও ফোনকল এসেছে মাহমুদের কাছে। তাতে নতুন করে হামলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। মাহমুদ বলেন, ‘তারা আমাকে ফোন করে আর বলে, এবার আরেকটি ভবনে তারা বোমা ফেলবে। তারপর আরেকটি। তারা বলেছে, যতক্ষণ না আমাদের কাজ শেষ হবে, ততক্ষণ আপনাকে ফোন করতে থাকব।’