গত বছরের ৭ অক্টোবর সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। গাজাভিত্তিক সংগঠনটির নজিরবিহীন এই হামলায় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। ২০০ শতাধিক ব্যক্তিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। হামলার ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ইসরায়েল। জবাবে ইসরায়েল তখন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে। ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৪১ হাজার। আহত প্রায় ৯৬ হাজার।
৭ অক্টোবরের হামলাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধ এখনো চলছে। আর সপ্তাহ দুয়েক পরই এই সংঘাতের এক বছর পূর্ণ হবে। এই প্রেক্ষাপটে বার্তা সংস্থা এএফপি তিন ইসরায়েলির সঙ্গে কথা বলেছে। ৭ অক্টোবরের ঘটনা তাঁদের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছে, তা তাঁরা তুলে ধরেছেন। এই আলাপে কেউ বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঘরে ফিরতে চান। আর কেউ চান যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে না পারার জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পতন।
রিজার্ভ সেনা কর্মকর্তা
ইসরায়েলের আপত্কালীন মজুত সেনা (রিজার্ভিস্ট) কর্নেল এরেজ রেগেভ। যুদ্ধের শুরুর দিকেই তাঁর ডাক পড়ে। তিনি যুদ্ধ করতে গাজায় যান। তাঁর খামার, শাকসবজির দোকান ও রেস্তোরাঁ আছে। যাওয়ার সময় এগুলো দেখভালের দায়িত্ব তিনি তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে যান।
পাঁচ সন্তানের বাবা এরেজ বলেন, যুদ্ধের প্রথম চার মাসে তিনিসহ তাঁর ইউনিটের কেউ বাড়িতে আসার সুযোগ পাননি।
১৯৬৭ সালে সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান অঞ্চলের দখল নেয় ইসরায়েল। গোলানের উত্তরাঞ্চলে এরেজের খেজুর ও আমের বড় বাগান আছে। এখানে তাঁর গ্রিনহাউস খামার আছে। বাগান ও খেতের নিয়মিত যত্নের প্রয়োজন পড়ে। তাই তাঁর মন পড়ে থাকে এই খেতখামারে। কারণ, এখানে তাঁর বিপুল বিনিয়োগ আছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে এরেজকে সব সময় একটা ঝুঁকি, অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটাতে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানকার সবকিছুই নাটকীয় ও ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। সব সময় মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে চলতে হয়।
এরেজ যখন ছুটি পেয়ে বাড়িতে যান, তখন তাঁর আরেক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি ঘুমাতে পারছিলেন না। কারণ, তাঁর মাথায় যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা কাজ করছিল।
এ প্রসঙ্গে এরেজের ভাষ্য হলো, ঘর ও যুদ্ধক্ষেত্রে—দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ। উভয় জগতেই উল্লেখ করার মতো এমন সব বড় বিষয় থাকে, যা ব্যক্তির জীবনকে খুব প্রভাবিত করে।
এরেজের ইউনিটের সব রিজার্ভ সেনাদেরই একই অবস্থা। তিনি জানান, তাঁর ইউনিটের সেনাসদস্যদের মধ্যে কৃষক, ব্যাংকার, শিক্ষকসহ নানা পেশাজীবী আছেন।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এরেজ ঘরে ফিরতে মরিয়া। এরেজ বলেন, শেষ কথা হলো, তিনি তাঁর গ্রিনহাউসের টমেটোখেতে ফিরে আসতে চান। সাতসকালে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বাগানে গিয়ে আম পাড়তে চান।
এরেজ নিরাপত্তা চান, স্থিতিশীলতা চান। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলছে, তবে শেষ পর্যন্ত তিনি নিরাপত্তা চান। তিনি তাঁর খেতে টমেটোর চারা রোপণ করতে চান। আর দুই মাস পর টমেটো তুলতে চান। এ জন্য বাড়িতে থাকতে পারবেন কি না, তা জানতে চান তিনি।
কনসার্ট থেকে বেঁচে ফেরা ব্যক্তি
হামাসের হামলার দিন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি কনসার্ট চলছিল। কনসার্টে যোগ দিয়েছিলেন নিৎসান পেরি। হামাসের যোদ্ধারা কনসার্টে হামলা চালান। সেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেখান থেকে তারা বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।
৩৩ বছরের পেরি বলেন, তিনি এখনো সেই আতঙ্ক থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেননি। তিনি নানান মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
৭ অক্টোবর স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে হামাসের ছোড়া রকেট যখন কনসার্টের মাঠে পড়ে, তখন নিজেদের গাড়িতে করে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালান পেরি ও তাঁর দুই বন্ধু। তবে হামাসের যোদ্ধাদের সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের ভেতর ঢুকে পড়ার বিষয়টি তখনো তাঁরা বুঝতে পারেননি।
ইসরায়েলের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, শুধু কনসার্টেই অন্তত ৩৭০ জনকে হত্যা করা হয়।
সেদিন বাড়িতে ফিরতে পেরির প্রায় ১২ ঘণ্টা লেগেছিল। কারণ, বাড়ি ফেরার পথে ঝুঁকি এড়াতে তিনি মাঝেমধ্যে প্রধান সড়ক এড়িয়ে চলেছিলেন।
৭ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে এই নারী একাকিত্ব, দুঃখবোধ, হতাশা ও আতঙ্কে ভুগছেন। সঙ্গীর সঙ্গে তাঁর আংটিবদল হয়েছিল। তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
পেরি কেশবিন্যাসের কাজ করেন। হামলার পর তিনি কয়েক মাস তাঁর ব্যবসা বন্ধ রাখেন। কারণ, তিনি কাজে মন দিতে পারছিলেন না।
পেরি বলেন, তাঁকে নানা সংকট ও উদ্বেগের অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। তিনি সব সময় বিরক্ত ও দুঃখী থাকেন। তাঁর বারবার ‘মুড সুইং’ হয়। এই মানসিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরি নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন।
আন্দোলনকারী
ইসরায়েলের রাজনীতি নিয়ে খুবই হতাশ ও ক্ষুব্ধ ইসরায়েলি আন্দোলনকর্মী কালানিত শ্যারন। তিনি ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, পরিস্থিতির কোনো বদল হয়নি, বরং আরও খারাপ হয়েছে।
৩৩ বছর বয়সী এই শিল্পী ‘পিং ফন্ট’ নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। সংগঠনটির সদস্যরা ২০২০ সাল থেকে ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকারের বিরোধিতা করে আসছেন।
ইসরায়েল থেকে যেসব ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে রাখা হয়েছে, তাঁদের ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত। কারণ, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে কোনো চুক্তির আশা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। চুক্তি নিয়ে আলোচনায় অচলাবস্থা চলছে। এই অচলাবস্থা, এই ব্যর্থতার জন্য ইসরায়েলের বর্তমান সরকারকে দুষছেন আন্দোলনকারীরা।
একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে গাজা থেকে জিম্মিদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনার দাবিতে ইসরায়েলে নিয়মিত বিক্ষোভসহ নানা প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। কর্মসূচিতে পিং ফন্টের সদস্যরাও অংশ নিচ্ছেন। তাঁরা গোলাপি রঙের পোশাক পরে, গোলাপি পতাকা হাতে নিয়ে, গোলাপি ড্রাম বাজিয়ে কর্মসূচি পালন করেন।
৭ অক্টোবরের হামলার জেরে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চল থেকে যাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেককে খাবার ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছিলেন পিং ফন্টের সদস্যরা।
শ্যারন বলেন, তাঁদের চলমান আন্দোলন বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তাঁরা মনে করেন, নেতানিয়াহুর সরকার বিদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।