ইরানে বিক্ষোভ
মরিয়ম মির্জাখানির দেশে আবারও রক্ত ঝরছে
ইরানের চলতি বিক্ষোভকে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে কেবল নারীদের উদীয়মান অভ্যুত্থান হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেশটির নাগরিকদের বহু ধরনের খারাপ অভিজ্ঞতার নির্যাস হিসেবেও বিবেচনা করা যায় একে।
ইরানকে আবার বিশ্বসংবাদে পরিণত করেছেন দেশটির নারীরা। হিজাব নিয়ে রাষ্ট্রের খবরদারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন তাঁদের একাংশ।
ইরানের নারীদের কথা এলে অনেকের মনে পড়বে মরিয়ম মির্জাখানিকে। ২০১৪ সালে গণিতের নোবেল ‘ফিল্ডস মেডেল’ পেয়েছিলেন তিনি। মরিয়ম একমাত্র নারী যে এই পদক পান।
ইরানে নারীদের হিজাব পরার আইনি হুকুম আছে। প্রচারমাধ্যমে হিজাবহীন নারীর ছবি প্রায় নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০১৭ সালে মরিয়ম যখন মারা যান তখন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি টুইটারে শোক প্রকাশ করেছিলেন মরিয়মের হিজাববিহীন ছবিসহ।
জীবিতকালে মরিয়ম গণিতে পুরুষ-আধিপত্যের ধারা ভাঙেন। তাঁর মৃত্যুও মহাশক্তিশালী ইরানি নেতাদের আইনি প্রথা ভাঙতে বাধ্য করে। তবে রুহানিই পুরো ইরান নন।
ইরানের কিছু কিছু গণমাধ্যম মরিয়মের সত্যিকারের ছবিতে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে হিজাব বসিয়ে ‘গণিতের রানি হারানোর’ শোকসংবাদ প্রকাশ করেছিল। ২০২১ সালের পর ‘সংস্কারবাদী’ তকমা নিয়ে রুহানিও নীরবতার আড়ালে হারিয়ে গেছেন।
জীবিত মরিয়ম, সংস্কারবাদী রুহানি এবং মৃত মরিয়মের ফটোশপের মাঝে ইরানি সমাজের ত্রিমুখী গভীর টানাপোড়েন টের পাবেন যেকোনো ভাবুক। ইরানের চলতি বিক্ষোভের পটভূমি ওই টানাপোড়েন।
আজকের ইরান আরও বহুভাবে মরিয়ম মির্জাখানির জীবনের মতো। দেশটির বিপ্লবের দিনক্ষণ হিসেবে সচরাচর ১৯৭৯ সালের কথা বলা হয়। তবে পাহলভি রাজবংশের বিরুদ্ধে ওই অভ্যুত্থানের শুরু ১৯৭৭ সালে কিছু বিক্ষোভ দিয়ে। মরিয়মের জন্মও ১৯৭৭ সালে। বলা যায়, মরিয়ম মির্জাখানি ও ইরান–বিপ্লব সমান বয়সী।
২০১৪ সালে ফিল্ডস মেডেল পাওয়ার তিন বছর পর মরিয়ম ক্যানসারে মারা যান। মরিয়মের মৃত্যুর আগে-পরে ইরান–বিপ্লবও দুরারোগ্য কোনো ব্যাধিতে পড়েছে কি না, সে বিষয়ে বিতর্ক এখন বিশ্বব্যাপী। তবে ইরানে প্রতিবছর নিয়মিত আটক, নিপীড়ন ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা জানাচ্ছে, দেশটি ভালো নেই।
যেখানে মৃতরা কেবল ‘সংখ্যা’
ইরানের বিক্ষোভের বিস্তারিত দেশের বাইরে থেকে জানা দুরূহ। ‘বিপ্লবী’ শাসকেরা ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছেন। তবে চোরাগোপ্তা প্রযুক্তিতে টুইটারে অনেক সংবাদ ও ভিডিও আসছে। তাতে দাবি, দেশটির ৩১ প্রদেশের ৩০টিতেই বিক্ষোভ চলছে। যার শুরু ১৬ সেপ্টেম্বর মাসা আমিনি নামের ২২ বছর বয়সী এক নারীর পুলিশের হাতে আটকের পর নিহত হওয়ার ঘটনা থেকে। এর দুই দিন আগে মাসাকে তেহরানের রাজপথ থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়, সঠিকভাবে হিজাব না পরার কারণে।
বিশ্বের অন্যত্র কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন যা বলে মাসার মৃত্যুর কারণ হিসেবেও সে রকম এক ভাষ্য দেওয়া হয় প্রথমে। পুলিশ বলছে, এই নারী তাদের হেফাজতে থাকলেও ‘হৃদ্যন্ত্র বিকল’ হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু তাঁকে আটক করে গাড়িতে তোলার ভিডিও ফুটেজ প্রচারমাধ্যমে চলে আসায় বোঝা যাচ্ছিল মাসা আটকের শুরু থেকে আঘাতের শিকার। এ ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যার রেশ আট দিন ধরে চলছে বিভিন্ন শহরে। তবে মাসা কুর্দিস্তানের মেয়ে হিসেবে ওই প্রদেশে বিক্ষোভ বেশি। মৃত্যুর সংখ্যাও সেখানে বেশি। কুর্দিস্তান হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্কের (কেএইচআরএন) হিসাবে, ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতি বিক্ষোভে ১২ জন মারা গেছে কেবল তাদের প্রদেশে। গ্রেপ্তার ৫৩০ জন। কেএইচআরএন মৃতদের সবার নাম-ঠিকানাও প্রকাশ করেছে, যা থেকে স্পষ্ট, ইরানের শাসকেরা যতই অস্বীকার করুক, বিক্ষোভে মৃত্যুর বৈশ্বিক সংবাদে অনেক সত্যতা আছে।
ইরানের ‘বিপ্লবী সরকারের’ সঙ্গে কুর্দিদের পুরোনো রাজনৈতিক সংঘাত আছে। মাসার মৃত্যু সেই দূরত্বও খানিক বাড়াল। এটা চলতি বিক্ষোভের নতুন দিক।
কুর্দি-অকুর্দি মিলে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত বিক্ষোভে মারা গেছেন ৩৫ জন। বেসরকারি হিসাবে ৫০। সর্বাত্মক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রপন্থী মৃত নাগরিকেরা সচরাচর কেবল ‘সংখ্যা’মাত্র।
নারীশরীর যখন রাষ্ট্রের বড় এক লক্ষ্যবস্তু
১৯৭৯ সাল থেকে ইরানে শাসকেরা নিয়ম করেছেন, নারীদের ঘরের বাইরে অবশ্যই হিজাব পরতে হবে, চুল ঢাকতে হবে।
বিষয়টি দণ্ডবিধির ৬৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ হিসেবে যুক্ত করা হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে নিয়মের লঙ্ঘনে তিন ধরনের শাস্তিও ঠিক হয়—দুই মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫ লাখ রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা অথবা ৭৪টি পর্যন্ত বেত্রাঘাত। নিয়ম মানানোর জন্য ২০০৪ সালের পর থেকে বিশেষ বাহিনীও প্রস্তুত হয়, ইরানে যা ‘গশতে এরশাদ’ নামে পরিচিত।
‘গশতে এরশাদ’ নিয়মিত রাস্তাঘাটে টহল দেয়। এ রকম ‘তদারকি টহল’ দল ‘বে-ঠিক’ পোশাক-আশাকের জন্য নিয়মিত অনেককে আটকও করে। আটককৃতদের যেখানে নেওয়া হয়, তার দাপ্তরিক নাম ‘এডুকেশন সেন্টার’। সেখানে কিছু বাধ্যতামূলক বক্তৃতা শুনতে হয়। পরিবারকেও ডেকে আনা হয় অনুরূপ উপদেশ শোনার জন্য।
তবে কড়া নিয়ম সত্ত্বেও ইরানে প্রকাশ্যে নারীদের সবাই কালো চাদরে মাথা মুড়িয়ে চলাফেরা করেন না। অনেকে পছন্দমতো স্কার্ফ পরেন। নিয়ম প্রতিপালনে ঢিলেঢালা ভাব আছে। সরকারের কট্টরপন্থীরা এতে সুখী নয়। নীতিনির্ধারক অনেকে মেয়েদের ঢিলেঢালা প্যান্টের বদলে লেগিংস বা টাইস পরা নিয়েও ক্ষুব্ধ। ‘নারী’ ১৯৭৯ সাল থেকে ‘বিপ্লব’-এর গুরুত্বপূর্ণ এক লক্ষ্যবস্তু।
তবে জনসমাজে হিজাব বা প্যান্ট নিয়ে কঠোরতা কমার পক্ষে মতামত বাড়ছে। ইরানের পার্লামেন্টারি রিসার্চ সেন্টার (পিআরসি)-২০১৮-এর ২৮ জুলাই এ বিষয়ে তাদের ৩৯ পৃষ্ঠার এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ মানুষ এখন সরকারের ‘ড্রেসকোড’ কঠোরভাবে পালনের পক্ষে। ১৯৮৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৬ শতাংশ।
‘ড্রেসকোড’ নিয়ে ধারাবাহিক টানাপোড়েনের ভেতরই মাসার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তীব্র ক্ষোভ থেকে বোঝা যাচ্ছে বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভূমিকায় জনসমাজে অসন্তোষ জমাট বেঁধে ছিল। সেই অসন্তোষ বাড়ে যখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ‘ড্রেসকোড’ লঙ্ঘন শনাক্ত করতে মুখাবয়ব শনাক্তকারী অত্যাধুনিক নজরদারি ক্যামেরা বসানোসহ আরও কিছু নির্দেশ দেন ১৫ আগস্ট। ৫ সেপ্টেম্বর আরব নিউজ, গার্ডিয়ানসহ বহু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন বের হয়। এ সময় থেকে হিজাবের বিরুদ্ধে কোনো অভিমত দেওয়াকেও শাস্তিযোগ্য করা হয়। রাইসির এ ঘোষণায় নারীদের গ্রেপ্তার বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মাসা আমিনির জন্য ইরানজুড়ে সংহতির মূলে রয়েছে সাম্প্রতিক ওই কঠোরতায় সৃষ্ট ভয় ও আপত্তি। তবে ‘বিপ্লবী সরকারের’ প্রতি আরও কিছু অসন্তোষও যুক্ত আছে এতে।
চলতি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আস্থা হারাচ্ছে মানুষ
ইরানের চলতি বিক্ষোভকে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম কেবল নারীদের উদীয়মান অভ্যুত্থান হিসেবে দেখাচ্ছে। কিন্তু দেশটির নাগরিকদের বহু ধরনের খারাপ অভিজ্ঞতার নির্যাস হিসেবেও বিবেচনা করা যায় একে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা অবস্থায় আছে মানুষ। এই সংকটের বড় দায় অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের। ইরানকে চাপে ফেলে পারমাণবিক প্রযুক্তি বিষয়ে চুক্তিতে বাধ্য করতে চায় তারা। তবে দীর্ঘ অবরোধেও ইরানের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যে চালু আছে, সেটা এক বিস্ময়। যদিও প্রবৃদ্ধির গতি ক্ষীণ।
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের অনুমান এ বছর ইরানে প্রবৃদ্ধি হবে ৩ শতাংশ। তবে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে প্রবৃদ্ধির সুফল জনগণের কোনোই কাজে আসছে না। এ বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত সরকারি হিসাবে—আগের ১২ মাসে জিনিসপত্র এবং বিভিন্ন সেবায় খরচ বেড়েছে ৪২ শতাংশ। জুনে এটা ৫৪ শতাংশে হয়েছে। ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির পর ইরানিরা এখন জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের মহামারিতে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের দায় মেটাচ্ছেন শাসক আয়াতুল্লাহরা নন, সাধারণ ইরানিরা।
রাজনীতি ও অর্থনীতি দুই দিকের চাপে নাগরিকদের হতাশা টের পাওয়া গিয়েছিল গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। তারা আর ভোট দিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। অর্ধেকের বেশি মানুষ (৫২ শতাংশ) গত নির্বাচনে ভোট দিতে আসেনি। আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে সর্বশেষটায় ভোটার কমে ২৫ শতাংশ। অথচ বিপ্লবের পর গণভোটে ইরানে ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল।
ভোটের প্রতি গণ-অনীহার এক কারণ নির্বাচনের মনোনয়নপ্রক্রিয়া। সমাজের নেতৃত্ব পর্যায়ে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা সংস্কারের পক্ষে এবং ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য। কিন্তু মনোনয়নপ্রক্রিয়া এত নিয়ন্ত্রিত যে তাতে উদারপন্থী কারও প্রার্থী হওয়ার সুযোগ কম।
ভোট নিয়ে ইরানিদের এই হতাশা প্রেসিডেন্ট, নাকি ‘সর্বোচ্চ নেতা’র পদকে ঘিরে, সেটা বিতর্কিত বিষয়। এবারের বিক্ষোভে প্রায়ই স্লোগান শোনা গেছে, ‘শাসকেরা নিপাত যাক।’ ১৯৭৭ সালের তেহরানেও এটাই ছিল জনপ্রিয় স্লোগান। প্রশ্ন হতে পারে, তখনকার রেজা শাহর জায়গায় এখন কাকে ‘শাসক’ ভাবছে জনতা? ক্ষমতার হিসেবে ইরানে সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক ‘রাহবার-এ মোয়াজ্জম’ বা ‘সর্বোচ্চ নেতা’—যদিও প্রেসিডেন্ট সেখানে প্রধান নির্বাহী।
রাহবার-এ মোয়াজ্জম হিসেবে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির তিন দশক পেরিয়ে গেছে বহু আগে। বয়সে তাঁর ৮৩ চলছে এখন। সাধারণ ইরানিরা জানে না খামেনির পর কে তাদের ‘সর্বোচ্চ শাসক’ হবেন।
সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনিই গত তিন দশক ইরানের সেনাপতিদের নিয়োগ দিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি বাছাই করেছেন—নীতিগত সব বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত তিনিই দিয়েছেন। কিন্তু কোনো বিষয়ে এই পদের কাছে জনতার জবাবদিহি চাওয়া কঠিন—পদ্ধতিগতভাবে সেটা দুরূহ করে রেখেছে ‘বিপ্লব’। এ রকম দমবন্ধ অবস্থার কারণেই ইরানে প্রতিবছর দুই-তিনবার করে সহিংস বিক্ষোভ হয়। আর এ রকম বিক্ষোভ তীব্র হলে রাস্তায় নামে সরকার সমর্থকেরাও। হুমকি আসে আইআরজিসি বা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের তরফ থেকেও। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার তারা হিজাববিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রতি হুমকি জারি করেছে। ‘গার্ড’দের সাপ্তাহিক সোব-এ-সাদিক–এর ২২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি শাসক-এলিটদের ভেতরকার সংস্কারবাদীদেরও তিরস্কার করা হয়। একই দিন কট্টরপন্থীদের কাগজ ক্যায়হান (মহাবিশ্ব) লিখেছে: ‘ক্রিমিন্যাল’দের প্রতি যেন দয়া দেখানো না হয়!
বাস্তবে সেটা দেখানোও হচ্ছে না। তবে নারীর মর্যাদার জন্য কোনো দেশে এক সপ্তাহে এত ‘অপরাধী’র রাজপথে আত্মদান বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ঠিক এ কারণেই সম্ভবত আগের সহিংস বিক্ষোভগুলো থেকে এবারের আন্দোলন বাড়তি আগ্রহ এবং সহানুভূতি পাচ্ছে। স্বভাবত এই আন্দোলন পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চলতি দর–কষাকষিতেও ছায়া ফেলবে। ইরানে আলী খামেনি-ইব্রাহিম রাইসি জুটি থাকাবস্থায় পাশ্চাত্যের এখনকার শাসকদের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আদৌ আর স্বাভাবিক হবে কি না, সে সন্দেহও তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। খামেনি-রাইসি-আইআরজিসি ত্রয়ীকে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে যেকোনো ছাড় সংস্কারপন্থীদের জন্য খারাপ বার্তা হিসেবে গণ্য হবে।
এই প্রেক্ষাপটেই এখন পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতার নাম খুঁজছে পশ্চিমের প্রচারমাধ্যম। বর্তমান বিক্ষোভের আগপর্যন্ত পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আঁচ-অনুমানে এগিয়ে ছিলেন আলী খামেনির পুত্র মোজতাবা খামেনি এবং প্রেসিডেন্ট রাইসি। রাইসির অধীনে চলতি রক্তাক্ত বিদ্রোহ তাঁর সম্ভাবনা কমিয়ে দিল। অন্যদিকে মোজতাবাকে আইআরজিসিরও পছন্দ হিসেবে মনে করা হয়। ইরানে স্বল্প পরিচিত কিছু প্রচারমাধ্যম (যেমন রাসা নিউজ এজেন্সি) সম্প্রতি তাঁর নামের আগে ‘আয়াতুল্লাহ’ পদবিও ব্যবহার করছে—সর্বোচ্চ পদের জন্য যে যোগ্যতা মানানসই হিসেবে ধরা হয়!
চলতি বিক্ষোভ দেশটির নিরাপত্তা অবকাঠামোকে পরবর্তী ‘রাহবার-এ মোয়াজ্জম’ খুঁজতে নিশ্চিতভাবে নতুন করে ভাবাবে। মোজতাবা খামেনি সে ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন। জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ‘অপরাধ’তুল্য বিবেচনা করে এগোতে হলে যেকোনো সামরিক আমলাতন্ত্রের অবশ্যই কঠোর এবং নির্মম পরিচালক দরকার হয়।
ইরানে এখন আত্মমর্যাদা রক্ষায় মানুষের যে শহীদি আত্মদান চলছে, তা সেখানকার সমাজের অনেক পবিত্র ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেবে অনেককে। কিন্তু এসব রক্তপাত শিগগিরই কোনো রাজনৈতিক সুসংবাদ বয়ে আনতে পারবে বলে মনে হয় না।
ব্যক্তি দুরারোগ্য সমস্যায় পড়লে তার পরিণত হয় ব্যক্তিগত। যেমন ঘটেছিল মরিয়ম মির্জাখানির ক্ষেত্রে। কিন্তু কোনো দেশ যদি একই রকম সমস্যায় পড়ে তার বেদনাময় পরিণতির ভাগ নিতে হয় সব নাগরিককে।
ইরানের এখনকার রক্তপাত তাই রাষ্ট্রচিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামসির সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করাচ্ছে: পুরোনো মরে যাচ্ছে, আর জন্ম নিতে সংগ্রাম করছে নতুন কিছু—মাঝখানে, এখন চলছে দানবের কাল।
● আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক