ইসরায়েল কেন সিরিয়ায় হামলা চালাচ্ছে
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের ঝটিকা অভিযানের মুখে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর দেশটিতে অব্যাহত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েল। গত রোববার নাটকীয়ভাবে দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় চলে যান বাশার। এরপর সিরিয়ায় চার শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
শুধু হামলাই নয়, জাতিসংঘের আপত্তি কানে না তুলে বাফার জোন (সংঘাতের প্রভাব এড়াতে বিশেষ অঞ্চল) পেরিয়ে সিরিয়ার ভূখণ্ডেও প্রবেশ করেছেন ইসরায়েলের সেনারা। ১৯৭৪ সালে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যকার একটি চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্তের গোলান মালভূমিতে এই বাফার জোন গড়ে তোলা হয়েছিল।
বিগত কয়েক মাসে লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের গাজার বাসিন্দাদের ওপরও যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে তারা। এই যুদ্ধে উপত্যকাটিতে ইসরায়েলি বাহিনী জাতিগত নিধন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরায়েল কেন এখন আবার সিরিয়ায় হামলা শুরু করল?
সিরিয়ায় হামলা কেন
বছরের পর বছর ধরে সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এর পেছনে দেশটির অজুহাত, সিরিয়ায় ইরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলো ধ্বংস করতেই হামলাগুলো চালায় তারা। যদিও ইরান বলেছে, সিরিয়ায় তাদের সামরিক বাহিনীর কোনো উপস্থিতি নেই।
এখন সিরিয়ায় চালানো হামলার পেছনের কারণ হিসেবে ইসরায়েল বলছে, তাদের লক্ষ্য হলো দেশটির সামরিক বাহিনীর সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা। তারা চাচ্ছে, সিরীয় বাহিনীর অস্ত্রগুলো যেন ‘চরমপন্থীদের’ হাতে না পড়ে।
ইসরায়েল কোথায় হামলা চালাচ্ছে
ইসরায়েল বলছে, তারা সিরিয়ার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রাগার, গোলাবারুদ সংরক্ষণাগার, বিমানবন্দর, নৌঘাঁটি ও গবেষণাকেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। সিরিয়া ও ইসরায়েলকে আলাদা করা গোলান মালভূমিসংলগ্ন বাফার জোনেও সেনা মোতায়েন করেছে তারা। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের অস্ত্রবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে এই বাফার জোনকে নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
গোলান মালভূমির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ইসরায়েলের দখলে। বাশারের পতনের পর বাফার জোনের ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাও তারা দখলে নিয়েছে। গোলান মালভূমির অবশিষ্ট এলাকার নিয়ন্ত্রণ সিরিয়ার কাছে।
সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েলের সাঁজোয়া যান গোলান মালভূমি থেকে সিরিয়ার ভূখণ্ডের ১০ কিলোমিটার ভেতরের কাতানা এলাকার দিকে অগ্রসর হয়েছে। এ এলাকা রাজধানী দামেস্কের খুব কাছে অবস্থিত। তবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সূত্রগুলো এ ধরনের অনুপ্রবেশের কথা অস্বীকার করেছে।
বাশার সরকারের পতনের পর দামেস্কের শতাধিক স্থানে হামলার পাশাপাশি দেশটির পূর্বে আল-মায়াদিন, উত্তর-পশ্চিমের তারতাস ও মাসায়াফ, লেবানন সীমান্তের কাসার ক্রসিং এবং দক্ষিণের সামরিক বিমানবন্দর খালখালাহতেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
একটি সার্বভৌম দেশে হামলার পেছনে ইসরায়েলের যুক্তি কী
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, গোলান মালভূমি–সংলগ্ন সিরিয়ার যেসব অঞ্চল ১৯৭৪ সাল থেকে নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল ছিল, সেগুলো ‘চিরদিনের জন্য’ ইসরায়েলের অংশ হিসেবেই থাকবে।
বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেন সার রোববার থেকে সিরিয়ায় চালানো হামলাকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্দেহভাজন রাসায়নিক অস্ত্রের স্থাপনা ও দূরপাল্লার রকেট উৎক্ষেপণকেন্দ্র লক্ষ্য করে তারা এসব হামলা চালিয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোয় ইসরায়েলের চলমান অভিযানের বিরোধিতাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে যেন এসব অস্ত্র না পড়ে, সে জন্যই এই হামলা চালানো হচ্ছে।
সিরিয়ায় ইসরায়েল কী চায়
সিরিয়ায় হামলার পেছনে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য কী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল সরকার শুধু বলেছে, তারা ‘ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার স্বার্থে’ কাজ করছে। এর বাইরে এমন কিছু বলেনি যা থেকে সিরিয়া ঘিরে দেশটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তবে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, সে বিষয়ে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন তাঁদের মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের একজন ইসরায়েলের ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির নেতা এবং নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেনি গানৎস। গত সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সিরিয়ায় হামলা চালানোটা ইসরায়েলের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ ছিল। তিনি দ্রুজ, কুর্দিসহ সিরিয়ার অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সোমবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সাবেক এক সদস্য এবং গবেষকের সাক্ষাৎকার নেয় সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েল। তাঁর প্রত্যাশা, বেনি গানৎসের চেয়ে বেশি। ওই গবেষকের মতে, সিরিয়া ছোট ছোট কয়েক অঞ্চলে ভাগ হয়ে যেতে পারে। প্রতিটি অঞ্চল ইসরায়েলসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।