এবার হজে কেন এত বেশি হাজির মৃত্যু হয়েছে

প্রচণ্ড গরমে অস্থির এক হাজি বোতল থেকে মাথায় পানি ছিটাচ্ছেন। ২০ জুন, মক্কায়ছবি: এএফপি

সৌদি আরবে এবার পবিত্র হজ পালন করতে গিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ মারা গেছেন প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে। এবার সৌদিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

আরব কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, হজে গিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৫৮ জন মিসরের নাগরিক। ইন্দোনেশিয়া বলেছে, তাদের দেশের ২০০–এর বেশি নাগরিক মারা গেছেন। ভারত বলেছে, তাদের ৯৮ নাগরিকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।

পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জর্ডান, ইরান, সেনেগাল, তিউনিসিয়া, সুদান ও ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চল তাদের নাগরিকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, তাদের দেশেরও বেশ কয়েকজন নাগরিক হজে গিয়ে মারা গেছেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধবান্ধব তাঁদের নিখোঁজ প্রিয়জনকে হাসপাতালে খুঁজছেন। তাঁদের খোঁজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও দিচ্ছেন।

মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবছর পবিত্র মক্কায় হজ পালন করতে যান। যেসব মুসলিম আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম, তাঁদের ওপর জীবনে অন্তত একবার পবিত্র হজ পালন ফরজ। চলতি বছর প্রায় ১৮ লাখ মুসলিম পবিত্র হজ পালন করেছেন বলে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, পবিত্র হজের সময় মারা যাওয়া অর্ধেকের বেশি মানুষ নিবন্ধন ছাড়াই হজ করতে এসেছেন। তাঁরা যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই এ দেশে এসেছেন। এ সময় তাঁরা তাঁবু বা বাসসহ অন্যান্য জায়গায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সুযোগ–সুবিধা পাননি।

সুদান গতকাল শুক্রবার বলেছে, যারা যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া মানুষকে পবিত্র মক্কায় গিয়ে হজের সুযোগ করে দিয়েছে, এমন বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকর্তাদের আটক করা হয়েছে। মিসরও একই ধরনের তদন্তের কাজ শুরু করছে।

সূর্যের তাপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে আরাফার ময়দানে ছাতা মাথায় হাজিরা। ১৫ জুন
ছবি: এএফপি

সৌদি আরব কয়েক বছর ধরে হজের সময় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এখনো সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ায় অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে তাদের সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে অনিবন্ধিত হাজিদের ক্ষেত্রে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এবারের মৃত্যু নিয়ে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

এবার কেন এত বেশি হাজির মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে চলছে নানা ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ। অবশ্য কিছু অভিন্ন কারণ প্রায় সবার কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে।

অত্যধিক গরম

এবার সৌদি আরবে এত বেশি হাজির মৃত্যুর জন্য অত্যধিক তাপপ্রবাহকে দায়ী করা হচ্ছে।

সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বারবার অত্যধিক গরমের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেছে। অযথা বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। সবাইকে বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছে। এরপরও সবাই সরকারি নির্দেশনা গ্রাহ্য করেননি। এতে অনেকে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এমনকি মারাও গেছেন।

নাইজেরিয়ার হাজি আয়শা ইদ্রিস বিবিসিকে বলেন, ‘একমাত্র আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে আছি। সত্যি অবিশ্বাস্য গরম পড়ছে। আমাকে সব সময় ছাতা ব্যবহার করতে হয়েছে এবং অবিরাম আমি নিজের মুখে–হাতে জমজমের পানি দিয়েছি।’

আরেক হাজি নাইম হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। ওই হাজির পরিবার এখন তাঁর মৃত্যুর কারণ কী, সেই উত্তর খুঁজছে।

ওই নারী হাজির সন্তান বিবিসি নিউজ অ্যারাবিককে বলেন, ‘হঠাৎ করে আমার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি হজের সময় মারা গেলেন কি না, সেটা জানতে আমরা তাঁকে কয়েক দিন ধরে খুঁজতে থাকি।’ তিনি বলেন, ‘তিনি মারা গেলে আমরা তাঁর শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁকে মক্কায় দাফনের ব্যবস্থা করব।’

হাজিরা এবার হঠাৎ করে এমন তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে পড়েছেন, যা তাঁরা আগে কখনো মোকাবিলা করেননি। সেখানে অধিকাংশ স্থান উন্মুক্ত। সোজা সূর্যের তাপ পড়ছে। হজ করতে আসা মানুষদের অনেকে বয়স্ক বা আগে থেকেই অসুস্থ।

প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে আরাফার ময়দানে অসুস্থ এক হাজিকে চিকিৎসা দলের সদস্যরা সরিয়ে নিচ্ছেন। ১৫ জুন
ছবি: এএফপি

অবশ্য সৌদি আরবে হজের সময় মৃত্যু নতুন কিছু নয়। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

জলবায়ুবিশ্লেষক কার্ল–ফ্রেডরিক স্কিউশনার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, উষ্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই বেশির ভাগ সময় হজ পালিত হয়ে আসছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।

কার্লের গবেষণা বলছে, শিল্পায়নপূর্ব যুগের চেয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে হজের সময়ে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকি পাঁচ গুণ বেড়েছে।

প্রচণ্ড ভিড় ও স্যানিটেশন

অনেকের মতে, এই প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা হাজিদের জন্য পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধাসংবলিত ব্যবস্থাপনা খুব বাজেভাবে করা হয়েছে। হাজিদের উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ও স্যানিটেশন–ব্যবস্থার তীব্র অভাব দেখা গেছে।

পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে আসা হাজি আমিনা (প্রকৃত নাম নয়) বলেন, ‘মক্কায় এই প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে আমাদের তাঁবুতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ছিল না। এয়ারকুলার যা–ও দেওয়া হয়েছে, তাতে পর্যাপ্ত পানি ছিল না।’

এই নারী হাজি বলেন, ‘এসব তাঁবুতে অনেকটা দমবন্ধ অবস্থা ছিল। আমরা প্রচণ্ডভাবে ঘামাচ্ছিলাম এবং পানিশূন্যতার মতো অবস্থা দেখা দিয়েছিল।’

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে আসা ফৌজিয়া বলেন, তাঁবুতে উপচে পড়া মানুষ আর অতিরিক্ত গরমের কারণে অনেকে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন।

হজ ব্যবস্থাপনার আরও উন্নয়ন হলে তাকে অবশ্য স্বাগত জানাবেন ফৌজিয়া। তবে তাঁর বিশ্বাস, এ পর্যন্ত এটিই হচ্ছে সবচেয়ে সুসংগঠিত হজ।

অবশ্য সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাজিদের কল্যাণে বরাদ্দ দেওয়া নানা বিষয়ের কথা তুলে ধরছে। সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হাজিদের জন্য মোট ৬ হাজার ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট ১৮৯টি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৪০ হাজারের বেশি চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান, প্রশাসনিক কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

পরিবহন

হজের সময় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাজিদের লম্বা দূরত্বের পথ হাঁটতে হয়। অনেকে এ জন্য সড়ক বন্ধ করা ও বাজে ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন।

বেসরকারি একটি হজ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আচা বলেন, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একজন হাজিকে দিনে কমপক্ষে ১৫ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়। এতে তাঁদের হিটস্ট্রোক, অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। অনেক সময় পানিও সহজলভ্য থাকে না।

মোহাম্মদ আচা বলেন, ‘এটি হচ্ছে আমার ১৮তম হজ। সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সহায়ক নয়। তারা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু মানুষকে সহায়তা করে না।’

মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে গিয়ে গরমে অসুস্থ হয়ে পড়া এক হাজিকে সহায়তা দিচ্ছেন এক নিরাপত্তাকর্মী। ১৬ জুন
ছবি: এএফপি

আচা ব্যাখ্যা করে বলেন, অতীতে ইউটার্ন নিয়ে তাঁবুর দিকে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত ছিল। এখন সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে একজন সাধারণ হাজি জোন–১–এর ‘এ’ শ্রেণির তাঁবুতে থাকলেও এই গরমে তাঁকে আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে তাঁর তাঁবুতে পৌঁছাতে হয়।

অবশ্য সৌদি আরবের পরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা হাজিদের যাতায়াতের জন্য ২৭ হাজার বাসের ব্যবস্থা রেখেছে।

অনিবন্ধিত হাজি

হজ করার জন্য একজন হজযাত্রীকে অবশ্যই হজ ভিসার আবেদন করতে হয়।

কিন্তু কিছু কিছু হজযাত্রী যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই সৌদি আরবে হজ করতে চান। সৌদি কর্তৃপক্ষ এই প্রবণতা বন্ধের চেষ্টা করলেও লাভ হচ্ছে না।

যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া সৌদি আরবে আসা হজযাত্রীরা কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। এমনকি সাহায্যের দরকার হলেও তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে যান না।

এই ‘অনানুষ্ঠিক হাজিরা’ এবার এত বেশি মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁবুতে অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য কর্তৃপক্ষ অনিবন্ধিত হাজিদের দায়ী করছেন।

ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল হজ অ্যান্ড ওমরা কমিশনের (কোমনাস হজ) চেয়ারম্যান মুসতালিহ সিরাজ বলেন, ‘আমরা সন্দেহ করছি, যাঁদের হজ ভিসা ছিল না, তাঁরা হজ এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছেন।’

সৌদি আরবের ন্যাশনাল কমিটি ফর হজ অ্যান্ড ওমরা–এর উপদেষ্টা সাদ আল–কুরাশি বিবিসিকে বলেন, হজ ভিসা না থাকলে কোনো ব্যক্তিকে বরদাশত করা হবে না। তাঁকে অবশ্যই নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

সাদ বলেন, নুসুক কার্ড ব্যবহার করে অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হাজিদের শনাক্ত করা হয়েছে। এসব কার্ড নিবন্ধিত হাজিদের জন্য ইস্যু করা হয়েছিল। পবিত্র মক্কায় প্রবেশের জন্য এই কার্ডের একটি বারকোড রয়েছে।

বয়স্ক, দুর্বল ও অসুস্থ হাজি

প্রতিবছর হজে মৃতুর আরেকটি কারণ হতে পারে এই যে অনেকে জীবনের শেষ প্রান্তে হজে আসেন। হজের জন্য সারা জীবন সঞ্চয় করে পরে হজ করেন।

আবার অনেক মুসলিম এই আশায় হজে আসেন, হজের সময় যদি তাঁদের মৃত্যু হয়, সেটা হবে আশীর্বাদের মৃত্যু। তাঁকে এই পবিত্র শহরে দাফন করা হবে।

পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফের সময় সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করছেন হাজিরা। ১৯ জুন
ছবি: এএফপি

হজের সময় কারও মৃত্যু হলে কী হবে

পবিত্র হজ পালনের সময় কারও মৃত্যু হলে বিষয়টি হজ মিশনকে জানানো হয়। তারা ওই ব্যক্তির পরিচয় শণাক্ত করতে মরদেহের হাতে বা পায়ে পরিচয় শনাক্তকরণ কার্ড লাগিয়ে দেয়। তারপর চিকিৎসক তাঁর মৃত্যুসনদ দেন। সৌদি সরকারও একইভাবে একটি মৃত্যুসনদ দেয়।

মৃত্যুর স্থানভেদে মৃত ব্যক্তিদের জানাজা মসজিদে হারাম বা মদিনায় পবিত্র মসজিদে নববিতে অনুষ্ঠিত হয়। তারপর মৃত ব্যক্তিদের গোসল, মরদেহ কফিনবন্দী করা এবং বরফে রাখার যাবতীয় খরচ সৌদি সরকার বহন করে থাকে।

তারপর মৃত ব্যক্তিদের দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। দাফনের কাজটি খুবই সাধারণ। কবরের কোনো চিহ্ন থাকে না। অনেক সময় একই স্থানে একাধিক মরদেহ দাফন করা হয়। কাকে, কোথায় দাফন করা হয়েছে, কবরস্থানে তার একটি তালিকা থাকে। সুতরাং পরিবারের কোনো সদস্য চাইলে মৃত স্বজনের কবর দেখে আসতে পারেন।

সৌদি আরব সরকার বলছে, বিভিন্ন সংস্থা ও রেড ক্রিসেন্টের সহায়তায় তারা ‘মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে মৃত ব্যক্তিদের দাফনের প্রক্রিয়া’ শেষ করে থাকে।

অনুবাদ: শাহজাহান সিরাজী