প্রথম ভূমিকম্পটি যখন আঘাত হানে, তখন ভোর হওয়ার খুব বেশি বাকি ছিল না। ইদলিবে ততক্ষণে জেগে উঠেছিলেন খাওলা ও তাঁর দুই ভাই। ৪৭ বছর বয়সী খাওলা ফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। কী হচ্ছে, বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ি থেকে বের হব, সেই উপায় ছিল না। আমার দুই ভাই অসুস্থ। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আর আমরা বের হয়ে তখন কোথায়ই–বা যেতাম।
পরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে ঠিক করলেন, সেখানেই খাওলারা থাকবেন। ভূমিকম্পে ভবনটি কেঁপে উঠলেও ধসে পড়েনি।
খাওলা বলেন, এখানে অনেক বাড়িঘরের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু এখানে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নেই। কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয়। প্রচণ্ড ঠান্ডা সত্ত্বেও এখানকার বাসিন্দাদের কেউ ভয়ে রাতটি রাস্তায়, কেউবা গাড়িতে কাটিয়েছেন।
সিরিয়ার উত্তর–পশ্চিমের ইদলিব শহরের খাওলা কথা বললেও নিরাপত্তার খাতিরে নিজের পুরো পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। কারণ, তাঁর শহরটি সিরিয়ার শেষ সীমান্তে, যা দেশটির স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
তুরস্কের সীমান্তবর্তী এই শহর গৃহযুদ্ধের পর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। শহরটি পুনরুদ্ধারে সিরীয় ও রুশ বাহিনী অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ভূমিকম্পের অল্প সময় পরও সিরীয় বাহিনী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত মারিয়া শহরে গোলা ছুড়েছে।
কয়েক বছরের যুদ্ধের কারণে এখানকার অবকাঠামো ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে চিকিৎসাসেবা দুষ্প্রাপ্য, উদ্ধারকাজও নেই বললেই চলে। এখানকার অধিকাংশ মানুষ আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।
সিরিয়ায় ত্রাণ পৌঁছানো বড় চ্যালেঞ্জ
স্থানীয় বাসিন্দাদের যারা বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে বসবাস করেন, তাঁরাও ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কাজ করা ফ্রাঙ্কফুর্টভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা মেডিকো ইন্টারন্যাশনালের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে কাজ করছেন অনিতা স্টারোস্তা। তিনি বলেন, এসব এলাকায় জরুরি সহায়তা পৌঁছানো অনেক চ্যালেঞ্জের।
অনিতা স্টারোস্তা বলেন, আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা আলেপ্পোর মতো এলাকায় সহায়তা পাঠানো বেশ কঠিন। এর মানে হলো, এসব এলাকায় কেউ আসাদ সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহায়তার সমন্বয় করতে পারছে না। এটাই সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, দামেস্ক সরকারের মাধ্যমে আসা বিদেশি সহায়তার প্রায় সবটাই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠরা নিজেদের মতো খরচ করে ফেলে। আসাদ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত ঘনিষ্ঠ স্থানীয় সাহায্য সংস্থাগুলোর হাতেই এই অর্থ যায়।’
হামবুর্গভিত্তিক জিআইজিএ ইনস্টিটিউট অব মিডল ইস্ট স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আন্দ্রে ব্যাংক বলেন, বিষয়টি করোনা মহামারির সময় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মহামারি চলাকালে আসাদ সরকার টিকা আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও সেগুলোকে নিজেদের পছন্দের গ্রুপগুলোর মধ্যে বিতরণের চেষ্টা করেছিল। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে তারা পাঠাতে চায়নি।
আন্দ্রে ব্যাংক বলেন, এর মধ্য দিয়ে দেখা যায় যে আসাদ সরকার নিজেদের লোকদের কতটা অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং আধিপত্য বজায় রাখতে কীভাবে এই সহায়তা কার্যক্রমকে ব্যবহার করেছে। আসলে শেষ কথা হচ্ছে, এখানে পশ্চিমা দেশগুলো ক্ষমতাসীন আসাদ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে না।
দুর্যোগকে আসাদ সরকারের নিজ স্বার্থে ব্যবহার
তুরস্ক–সিরিয়ায় ভূমিকম্প আঘাত হানার মাত্র কয়েক দিন হলো। ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কীভাবে আসাদ সরকার তার নিজের লক্ষ্য পূরণে এই বিপর্যয়কে ব্যবহার করতে চাইছে। ব্যাংক বলেন, সাহায্যকারী সংস্থা সিরিয়ান আরব রেড ক্রিসেন্ট (যা সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ) ইতিমধ্যেই আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি তুলেছে, যাতে (ভূমিকম্পবিধ্বস্ত এলাকায়) সাহায্য করা সহজ হয়।
আন্দ্রে ব্যাংক বলেন, ওই সংস্থার বক্তব্য দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে দামেস্কের অভিজাতরা কৌশলে দুর্যোগকে কাজ লাগানোর পরিকল্পনা করছে।
ইউরোপে এক ডজনের বেশি সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধিত্বকারী বার্লিনভিত্তিক জার্মান–সিরীয় এইড অ্যাসোসিয়েশনের (ভিডিএসএইচ) ডিপুটি চেয়ার সাফো লাবানিহ এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, আসাদ সরকার সত্যিকার অর্থে সিরিয়ার সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে চায় না। আমি এখনো মনে করি, সরকার এই দুর্যোগকে ব্যবহার করে এককভাবে সহায়তা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক বৈধতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে।’
ভূমিকম্প ও পরাঘাতে বিধ্বস্ত সিরিয়ায় আসাদ সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোয় এখন এ ধরনের নানা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
কিন্তু সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সহায়তা পৌঁছানো আরও বেশি জটিল। যেমন ইদলিব। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষের বসবাস। ভূমিকম্পের আগেও সেসব এলাকায় সহায়তা বা ত্রাণ সরবরাহ কঠিন ছিল।
তুরস্ক–সিরিয়া সীমান্তের একমাত্র বাব আল-হাওয়া সীমান্ত দিয়েই মানবিক সাহায্য ও অন্যান্য সহায়তা আসে। এই সীমান্ত জাতিসংঘের সনদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ছয় মাস পর এটি নবায়ন করতে হয়। সাধারণ মানুষের জীবনমান এখানে কোনো বিষয় নয়। এই অঞ্চল প্রায়ই সিরিয়া সরকার ও তার রুশ মিত্রদের কাছে রাজনৈতিক ফুটবল খেলায় পরিণত হয়েছে।
সহায়তার জন্য সীমান্ত খুলুন
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা ত্বরান্বিত করতে তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে সব সীমান্ত খুলে দেওয়া উচিত বলে যুক্তি তুলে ধরেছেন। জিআইজিএ গবেষক ব্যাংকও এর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, এটি বাস্তব পরামর্শ। তিনি বলেন, দুই দেশের দীর্ঘ সীমান্তে ২০টির বেশি সীমান্ত পারাপার এলাকা রয়েছে। সিরিয়া অংশে বেশির ভাগই আসাদ সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। তারা ততটা কট্টর নয়, তুরস্কের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এভাবে কেউ চাইলে আসাদ সরকার, রাশিয়া বা ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা এড়াতে পারে।
আন্দ্রে ব্যাংক বলেন, একইভাবে আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংস্থাগুলো চাইলে সিরিয়ার বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশে চরমপন্থী ইসলামি বিদ্রোহী পক্ষগুলোকেও এড়িয়ে চলতে পারবে।
মেডিকো ইন্টারন্যাশনালের স্তারোস্তাও এই কথা মানেন। এই এলাকায় বাস্তুচ্যুত সিরীয়দের পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্তারোস্তা বলেন, ভূমিকম্পের আগে যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল, তা পর্যাপ্ত ছিল না এবং কখনো কখনো তা এই এলাকায় পৌঁছাত না। এখন শীতকাল। খুব ঠান্ডা। এর অর্থ হচ্ছে, শিবিরে থাকা বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং ইদলিবের যেসব এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে, সেখানকার মানুষ আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর আগের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল।
এসবই একটি জিনিসের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করেন স্টারোস্তা। তিনি বলেন, যাঁরা নিরাপত্তার খাতিরে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের ফেরাতে তুরস্ক মানবিক করিডর খুলবে, নাকি দেশটি তার রাজনৈতিক অবস্থানে অটল থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দেবে। দুর্ভাগ্যবশত মনে হয়, পরেরটিই হবে।
আপাতত, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সিরীয়দের সাহায্য বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অথচ ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো যাঁরা আটকা আছেন, তাঁদের বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে।
খাওলা ও তাঁর দুই ভাইও এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাতারে আছেন। তাঁদের ইদলিবে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। হতাশামাখা কণ্ঠে খাওলা বলেন, ‘একসময় রকেট হামলা, এরপর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট আর এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমাদের এসব ধকল কাটিয়ে ওঠার বা স্বস্তির নিশ্বাস নেওয়ার আর সুযোগ হয়ে ওঠে না। কীভাবে একজন মানুষ এসব সহ্য করবে?’