ইসরায়েলকে বাঁচাতে যুগের পর যুগ যেভাবে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র
ফিলিস্তিনের গাজায় রক্তপাত বন্ধের লক্ষ্যে গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেওয়ায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। ইসরায়েলকে বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার ব্যবহার এবারই প্রথম নয়। যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহাসিক মিত্র ইসরায়েলের পাশে থেকেছে সব সময়।
গতকাল বৈঠকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এতে গাজায় ‘মানবিক বিবেচনায় বিরতির’ কথা বলা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে ইসরায়েলের। অন্যদিকে গাজায় ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’ চেয়ে প্রস্তাব দেয় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী অপর দুই সদস্যদেশ রাশিয়া ও চীন। তবে প্রস্তাবটি পাস হয়নি। কারণ, এতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে।
১৯৪৫ সাল থেকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনসংশ্লিষ্ট ৩৬টি প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে তোলা হয়। প্রতিবারই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো না কোনো স্থায়ী সদস্যদেশ। তবে এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪ বার ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর রাশিয়া ও চীন একবার করে ভেটো দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। অপর দিকে অস্থায়ী ১০ সদস্য রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে সবার ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তবে যেকোনো প্রস্তাব পাসে স্থায়ী পাঁচ সদস্যের সবার সম্মতির দরকার হয়। কোনো একটি স্থায়ী সদস্যদেশ ভেটো দিলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। এতে বিদেশি নাগরিকসহ ১ হাজার ৪০০-এর বেশি ইসরায়েলি নিহত হন। এর প্রতিশোধ হিসেবে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে সাত হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক বলে জানা গেছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরুর পর গতকাল দ্বিতীয় দফায় ভোটাভুটি হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। ১৮ অক্টোবর এই ইস্যুতে প্রথম দফায় ভোট হয়। সংঘাত বন্ধে ব্রাজিল ‘মানবিক যুদ্ধবিরতির’ প্রস্তাব উপস্থাপন করলেও দুবার এ নিয়ে ভোটাভুটি পেছায়। শেষমেশ ১২টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। এতে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।
ভেটো দিয়ে ইসরায়েলকে রক্ষার ইতিহাস
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কিংবা ইসরায়েলের জন্য হুমকি—এমন যেকোনো প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে তোলা হলেই যুক্তরাষ্ট্র তাতে ভেটো দেয়। সম্প্রতি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৪৫ সাল থেকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনসংশ্লিষ্ট ৩৬টি প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে তোলা হয়। প্রতিবারই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো না কোনো স্থায়ী সদস্যদেশ। তবে এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪ বার ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর রাশিয়া ও চীন একবার করে ভেটো দিয়েছে।
গত ৭৮ বছরে নিরাপত্তা পরিষদে তোলা এসব প্রস্তাবের অধিকাংশই ছিল কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে একটি শান্তি কাঠামো প্রণয়ন–সংক্রান্ত। এসব প্রস্তাবে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ও ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে বিতরণ করে তাদের ভূখণ্ড দখল করে ইহুদি বসতি নির্মাণের নিন্দা জানানোর কথা হয়।
ফিলিস্তিন ইস্যু ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ঘটনায় ইসরায়েলের পক্ষ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে মোট ৪৬ বার নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলকে বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ লেবাননে হামলাসহ সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেওয়ার ঘটনা রয়েছে। নিজেদের কয়েক দশকের পুরোনো নীতিকে পাশ কাটিয়ে ২০১৯ সালে গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের ভূখণ্ড বলে স্বীকৃতি দেয় ওয়াশিংটন।
১৯৭২ সালে মাত্র একবারই ইসরায়েলের পক্ষে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থেকেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তখন সব পক্ষকে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো
ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজা খালি করে দেওয়ার নির্দেশ বাতিল করে সেখানে ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর করতে ১৮ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব তোলা হয়। তবে সেই প্রস্তাবে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই দিন জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘হ্যাঁ, প্রস্তাবগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা পরিষদের অবশ্যই সোচ্চার হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা যেসব পদক্ষেপ নেব, তা যেন মাঠের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।’
২০১৮ সালে গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনিরা ব্যাপক বিক্ষোভ করেন, যাকে ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ বলা হয়ে থাকে। এ সময় ইসরায়েলের হামলায় ২৬৬ ফিলিস্তিনি নিহত হন। ওই ঘটনায় নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব তোলা হয়। এতে ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের নিন্দা জানানো হয়। এ সময় দুই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবটি একপেশে বলে এতে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়ায় নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব তোলা হয়। এতে বলা হয়, পবিত্র নগরী জেরুজালেমের ভৌগোলিক চরিত্র, অবস্থান, জনমিতিক বিন্যাসকে পাল্টানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপের আইনি বৈধতা নেই। এটি অকার্যকর। এতে জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষার দাবি জানানো হয়।
নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তেফাদার সময়ও নিরাপত্তা পরিষদে তোলা প্রস্তাবে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় মর্মান্তিক ও সহিংস ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। পাশাপাশি নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যার ঘটনায় ইসরায়েলের নিন্দা জানানো হয়। ১২টি সদস্যদেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।