‘বন্ধু’ নাসরুল্লাহকে হারিয়ে গাজায় কেউ কাঁদছেন, কারও কপালে চিন্তার ভাঁজ
ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর নিহত হওয়ার খবরে গাজার অনেক ফিলিস্তিনির হৃদয় ভেঙে গেছে। তাঁরা নাসরুল্লাহর মৃত্যুতে শোকাহত। এমনই একজন বাসমা আল-হেলু। গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান ৭৪ বছরের এই বৃদ্ধা। বর্তমানে গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর-আল-বালাহ শহরে একটি অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করছেন বাসমা ও তাঁর স্বামী।
বেদনা জড়ানো গলায় বাসমা আল-হেলু বলেন, ‘আমরা চাই না কারও জীবন এমন (তাঁবুতে বসবাস) হোক, লেবাননে আমাদের ভাইদের জন্য তো নয়ই। যুদ্ধ অসহনীয় এবং বছরজুড়ে আমরা এর ভয়াবহতা অনুভব করছি। ইসরায়েল লেবাননে হামলা শুরু করলে আমি ভেঙে পড়েছিলাম।’
‘নাসরুল্লাহ পুরো জীবন আমাদের পাশে ছিলেন, সব সময় ইসরায়েলকে প্রতিহত করেছেন। আমি টেলিভিশনে তাঁর (নাসরুল্লাহর) ভাষণের কথা মনে করি। সেগুলো শক্তির উৎস ছিল। তাঁকে হারানোর ক্ষতি অপূরণীয়।’ গাজার ফিলিস্তিনি বাসমা আল-হেলু
বাসমার এই কষ্ট আরও বহুগুণ বেড়ে যায়, যখন তিনি শুনতে পান হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে বৈরুতে ইসরায়েলের হামলায় নাসরুল্লাহ প্রাণ হারান। বাসমা বলেন, ‘এটা শুনে আমার হৃদয় ভেঙে যায়। আমরা আশা করেছিলাম, এ খবর যেন সত্যি না হয়।’
একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে বাসমা কখনো ফিলিস্তিনিদের প্রতি নাসরুল্লাহর অটুট সমর্থন ভুলে যাবেন না বলেও জানান। তিনি বলেন, ‘নাসরুল্লাহ পুরো জীবন আমাদের পাশে ছিলেন, সব সময় ইসরায়েলকে প্রতিহত করেছেন। আমি টেলিভিশনে তাঁর (নাসরুল্লাহর) ভাষণের কথা মনে করি। সেগুলো শক্তির উৎস ছিল। তাঁকে হারানোর ক্ষতি অপূরণীয়। জানি না যুদ্ধ বন্ধ করতে তাদের (ইসরায়েল) কী চাই। তারা ইসমাইল হানিয়েকে হত্যা করেছে, তারা আরও অনেক নেতাকে হত্যা করেছে। আমাদের মনে হচ্ছে অত্যাচারী যুদ্ধবাজদের সামনে আমরা একা দাঁড়িয়ে আছি।’
‘গাজায় আমরা যে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, লেবাননেও সেটাই ঘটছে...বোমা হামলা, ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি। লেবাননের জন্য আমাদের খুব দুঃখ হচ্ছে। তাদেরও (আমাদের মতো) একই ভাগ্য বরণ করে নিতে হচ্ছে। কারণ, তারা গাজার পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং ইসরায়েলকে ‘না’ বলেছিল।’ গাজার ফিলিস্তিনি জাকি শেখ খলিল
‘নাসরুল্লাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন’
গাজার আরেক ফিলিস্তিনি জাকি শেখ খলিলের (৬৪) অনুভূতিও একই। তিনি বলেন, ‘যখন বাকিরা আমাদের পরিত্যাগ করেছে, তখন নাসরুল্লাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমাদের পাশে যে–ই দাঁড়াবেন, তাঁর জাতীয়তা বা ধর্ম যা–ই হোক, আমরা তাঁর বা তাঁদের ক্ষতি বা মৃত্যুতে শোক জানাব।’
জাকি আরও বলেন, কেউ বলেন নাসরুল্লাহ শিয়া, সুন্নি নন। তাঁর কারণে সিরিয়ায় বিভেদের সৃষ্টি বলে কেউ কেউ মনে করেন। এ নিয়ে জাকি শেখ বলেন, ‘বিভেদ যা–ই হোক, আমরা নাসরুল্লাহকে মনে রাখব। তিনি গাজার সমর্থনে ইসরায়েলের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। শত্রু একজনই এবং ইসরায়েল আমাদের শত্রু। নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ড তাদের জন্য জয়।’
গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে পাঁচবার গৃহহীন হয়েছেন এই ফিলিস্তিনি। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেন, ‘গাজায় আমরা যে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, লেবাননেও সেটাই ঘটছে... বোমা হামলা, ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি। লেবাননের জন্য আমাদের খুব দুঃখ হচ্ছে। তাদেরও (আমাদের মতো) একই ভাগ্য বরণ করে নিতে হচ্ছে। কারণ, তারা গাজার পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং ইসরায়েলকে ‘না’ বলেছিল।’
নিঃসাড় হয়ে পড়েছেন অনেকে
পাঁচ সন্তানের জননী ৩৬ বছরের হিবা মুরাদ। নাসরুল্লাহর মৃত্যুর খবরে শোকে তিনি নির্বাক। কেমন যেন অসাড়তা ভর করেছে তাঁর শরীর ও মনে। তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ আমার অনুভূতি ভোঁতা করে দিয়েছে। আমার জীবন অসহনীয়।’
তবে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়লেও নাসরুল্লাহর নিহত হওয়ার খবরে দুঃখ পাননি, এমনটা নয় বলে জানান এই নারী। তিনি বলেন, ‘আমার চারপাশের সবকিছু জঘন্য ও ঘৃণ্য। আমরা এমন এক জগতে আছি, যেখানে নৈতিকতা বা অনুভূতি বলে কিছু নেই। তারা (ইসরায়েল) হামাস ও হিজবুল্লাহকে পরাজিত করতে হানিয়ে ও নাসরুল্লাহর মতো নেতাদের ওপর হামলার কথা বলে। কিন্তু তারা বেসামরিক মানুষদের ওপর হামলা করে যাচ্ছে। শুধু নেতারা নন, আমরাও এই দুর্ভোগ পোহাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, এসব কিছু দেখে তাঁর হাসি পায়।
গাজায় হামাসের নতুন নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অবস্থানও সম্ভবত ইসরায়েল জানে বলে মনে করেন হিবা। তিনি বলেন, কিন্তু তারা (ইসরায়েল) তাঁকে (হামাসপ্রধান) লক্ষ্য করে এখনই হামলা চালাচ্ছে না। ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে খোঁজার নাম করে ইসরায়েল আরও ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে।
ইসরায়েল রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে যেকোনো কিছু করার সুবিধা নিচ্ছে বলেও মনে করেন এই নারী। তিনি বলেন, ‘আর কেউ গাজায় আমাদের সমর্থন দেবে বলে মনে হয় না। কারণ, এ জন্য কী মূল্য দিতে হবে, তা সবার জানা। যে–ই গাজাকে সমর্থন দেবে, তাঁকেই নাসরুল্লাহ ও লেবাননের মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে।’