মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি। পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। তেহরানও বলেছে, ইসরায়েল আবার হামলা করলে পরিণতি হবে ধ্বংসাত্মক। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করেছে ইরান–সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের সশস্ত্র হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের সেনাদের মধ্যে সম্মুখ লড়াই চলছে। গতকাল বুধবার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি আট সেনা। ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গতকালও গাজায় অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারালেন।
গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে এক বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়ছে হিজবুল্লাহ ও হুতি। তাদের সমরাস্ত্র ও আর্থিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে ইরান। পাশাপাশি গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসকেও সহযোগিতা করে আসছিল তেহরান। ইরান সরাসরি জড়িত না থাকলেও ইসরায়েলের সঙ্গে চলছিল ছায়াযুদ্ধ। মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধে ইরান সরাসরি জড়িয়ে পড়ল।
গত শুক্রবার লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। এরপর সোমবার রাতে লেবাননে সেনা পাঠায় ইসরায়েল। এরপর ইরান প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলে হামলা করে। এতে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্য। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ইরানের হামলার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
■ গতকাল লেবাননে সশস্ত্র লড়াইয়ে ইসরায়েলের আট সেনা নিহত। ■ জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ইসরায়েলের। ■ মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলে প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। ■ ইসরায়েলের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে তারা।
এদিকে গতকাল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এ হামলায় অন্তত তিনজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। ইরান–সমর্থিত ইরাকের মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো হুমকি দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি এই সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষে অংশ নেয়, তাহলে ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে শুরু করবে তারা।
ইরান ও ইসরায়েলকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বিশ্বনেতারা বলছেন, এই সংঘাত এখনই বন্ধ না করা গেলে পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। তবে বরাবরের মতোই ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সেনাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছে ওয়াশিংটন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দেবে। তবে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা সমর্থন করে না যুক্তরাষ্ট্র—এ কথাও বলেছেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্য এখন একটি সর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডনের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর রাইদ জারার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসে, তাহলে এর সমাপ্তি ঘটবে না। যুক্তরাষ্ট্রকে বলতে হবে যে তারা আর ইসরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ ও সহযোগিতা দেবে না।
দ্ব্যর্থহীনভাবে ইরানের হামলার নিন্দা না জানানোর অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের কঠোর সমালোচনা করেছে ইসরায়েল। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলে গুতেরেসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণাও করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে ফ্রান্সের আহ্বানে গতকাল জরুরি বৈঠক করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত দাবানলের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত থামানোর এখনই সময়। সংঘাত এভাবে ছড়াতে থাকলে সাধারণ মানুষকে চরম মূল্য দিতে হবে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো ওমর রহমান বলেন, ইসরায়েল যে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। পুরো অঞ্চলে যাতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, বিগত কয়েক মাসের তৎপরতার মধ্য দিয়ে সেই চেষ্টাই চালিয়েছে ইসরায়েল। এ যুদ্ধে যাতে সরাসরি জড়াতে না হয়, সেই চেষ্টা করেছে ইরান। কিন্তু এখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একধরনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
পাল্টাপাল্টি হুমকি
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কঠোর ও সমুচিত জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইরান অনেক বড় ভুল করেছে। এর মূল্য দিতে হবে তাদের। যারাই আমাদের ওপর আক্রমণ করবে, আমরা পাল্টা আক্রমণ করব।’
প্রধানমন্ত্রীর সুরে হুমকি দিয়ে কথা বলেছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ইরান খুব সাধারণ একটা শিক্ষা নেয়নি। যারাই ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করে, তাদেরই এর চড়া মূল্য দিতে হয়।
ইরানের হামলার জবাব কীভাবে দেওয়া যায়—এ নিয়ে সামরিক নেতৃত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে গতকাল দফায় দফায় বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েল যে পাল্টা হামলা চালাবে, তা নিশ্চিত। তবে কখন ও কীভাবে ইসরায়েল এ হামলা চালাবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
পাল্টা হুমকি দিয়ে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েল যদি আবার হামলা চালায়, তাহলে আরও বড় পরিসরে হামলা চালাবে তারা, যার পরিণতি হবে ধ্বংসাত্মক।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান গতকাল বলেছেন, ইসরায়েল যদি অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ না করে, তাহলে কঠোর পরিণতির মুখে পড়তে হবে তাদের। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি আবার হামলার হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল যদি ইরানে হামলা চালায়, তাহলে বিভিন্ন দিক থেকে আরও বড় পরিসরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে তেহরান।
যুদ্ধ ছড়ানোর শঙ্কা
মূলত হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা ও লেবাননে স্থল হামলা শুরুর কারণেই মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরান বলেছে, ইসরায়েলে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ছিল অত্যাধুনিক। এগুলোর মধ্যে শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রও ছিল। যদিও ইসরায়েলের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে তারা।
গত এপ্রিলে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলায় আইআরজিসির জ্যেষ্ঠ কমান্ডার মোহাম্মদ রেজা জাহেদিসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। এর জেরে ওই মাসে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল ইরান। তবে এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল মঙ্গলবারের হামলা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এপ্রিলের ওই হামলা ছিল সীমিত পরিসরে। কিন্তু মঙ্গলবার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলে হামলা করে ইরান। এবারের হামলায় ফাতাহ-১ ও খাইবারশেকান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে দেশটি। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তাঁরা মনে করেন, ইরান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছে।
গতকাল থেকে হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে রকেট হামলা বাড়িয়েছে। এদিকে লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজ লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে হুতি বিদ্রোহীরা। ইরান-সমর্থিত ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে যদি যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেয়, তাহলে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাবে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেনের মতে, গত বছরের অক্টোবর থেকেই ইসরায়েল একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। গতকাল নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের দিক থেকে বিবেচনা করলে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকেই আমরা একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। এখন একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো।’
লেবাননে আরও ইসরায়েলি সেনা
লেবাননে ইসরায়েলি সেনা ও হিজবুল্লাহর সদস্যদের মধ্যে সম্মুখ লড়াই চলছে। গতকাল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, লেবাননে আরও সেনা পাঠিয়েছে তারা। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে সশস্ত্র লড়াইয়ে ইসরায়েলের আট সেনা নিহত হয়েছেন বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।
এক বছর আগে গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকেই এর প্রতিবাদে ইসরায়েলে হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহ। শুক্রবার ইসরায়েলি হামলায় হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলে হামলা জোরদার করে হিজবুল্লাহ। এরপর গত সপ্তাহে লেবাননে নির্বিচার বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েলে। ইসরায়েলি হামলায় এরই মধ্যে লেবাননে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
স্থল হামলার পাশাপাশি গতকাল লেবাননে বিমান হামলাও চালায় ইসরায়েল। গতকাল সকাল থেকে ইসরায়েলি বাহিনী রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণের এলাকাগুলো থেকে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তবে প্রতিরোধের মুখে অনেক স্থান থেকে ইসরায়েলি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হন বলে দাবি হিজবুল্লাহর। সংগঠনটি গতকাল রাতে ইসরায়েল লক্ষ্য করে অন্তত ১০০ রকেট ছুড়েছে।
ইসরায়েলের হামলার মধ্যে লেবাননে গত কয়েক দিনে ১০ লাখের বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার মুখে অনেক দেশ লেবানন থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে।