এবারের রোজা উৎসব আনেনি ওদের জীবনে
আরবের আকাশে সাঁঝের ছোঁয়া। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠছে বাতি। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলেই মুখে ইফতারি তুলবেন সবাই। পবিত্র রমজানে মুসলমানদের কাছে এ এক উৎসবের মুহূর্ত। ঠিক একই সময়ে ফিলিস্তিনের গাজার চিত্রটা আলাদা। সেখানে ইফতারের জন্য নেই খাবার, নেই পানি, নেই কোনো আয়োজন। আছে শুধু ক্ষুধার্ত শিশুদের আর্তনাদ আর তাদের বাবা-মা—পরিবারের সদস্যদের চেহারায় একরাশ হতাশা। ফিলিস্তিনিদের এবারের রোজার আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা।
অথচ এই গাজাতেই রোজা মানে ছিল উৎসব, আয়োজন, মানুষে মানুষে মিলে যাওয়া। এই তো গত বছরও পবিত্র রমজান উপলক্ষে সন্ধ্যা হলেই সেজে উঠত গাজার ঘরবাড়ি ও সড়কগুলো। জ্বলত রমজানের লন্ঠন, রংবেরঙের বাতি। পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে আয়োজন করা হতো হরেক পদের ইফতারির। রাত গড়িয়ে গেলেও রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কমত না। আনন্দে মেতে উঠত শিশুরাও। সন্ধ্যার পর থেকে রাস্তায় খেলাধুলা করে, দল বেঁধে ধর্মীয় গান গেয়ে মাতিয়ে রাখত মহল্লা।
সেদিনগুলোর কথা এখন দীর্ঘশ্বাস হয়ে ফেরে উত্তর গাজার বাসিন্দা রাওয়ান্দ আলতাতারের কাছে। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এই তরুণীর মহল্লার বেশির ভাগ বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেখানেই গত বছর রোজ সাহ্রির সময় একজন ঢোল পিটিয়ে সবাইকে ঘুম থেকে জাগাতেন। এবার তিনি নেই। হয়তো ইসরায়েলের নিষ্ঠুর বোমা তাঁর প্রাণ কেড়েছে। আলতাতারের বাড়ির রাস্তায় আলোকসজ্জাও নেই। রোজার দিনগুলোয় পরিবারের সদস্যদের কথা বেশি মনে পড়ছে তাঁর। একসঙ্গে রোজা রাখাটা এবার হচ্ছে না।
এবারের রমজানে আলতাতারের গল্পটা পুরো গাজাবাসীর সঙ্গে মিলে যায়। প্রায় ছয় মাস ধরে চলা নিষ্ঠুরতায় অনেকে সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বোনের মতো প্রিয় মুখগুলোকে চিরদিনের মতো হারিয়েছেন। খাতা-কলমের হিসাবে মৃত্যু ৩২ হাজার ছুঁই ছুঁই। প্রতিদিনই বাড়ছে লাশের সারি। অনেকেই আবার হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ অচেনা পথে, হয়েছেন পরিবারছাড়া।
ঘরছাড়া এই মানুষগুলোর একজন ৩৭ বছর বয়সী হানা আল-মাসরি। গাজার একেবারে দক্ষিণে রাফায় জীর্ণ একটি তাঁবুতে বসে গত রমজানের স্মৃতি খুঁজে ফিরছিলেন তিনি। আগের দিনে মাসটি উপলক্ষে তাঁর ছোট্ট মেয়েরা সারা বছর অর্থ জমাত। মেয়েদের রমজানের লন্ঠন কিনে দিতেন। সাহ্রি-ইফতারে রান্না করতেন মজাদার সব খাবার। এবার সেসবের কিছুই হচ্ছে না।
সাহ্রি-ইফতারে একটু ভালো খাবারের আয়োজন গাজাবাসীর কাছে এখন বিলাসিতা। দিনে এক বেলা এক মুঠো অন্ন জোগাড় করাই তো দায়। অসহায় মানুষগুলোর জন্য দরকারি ত্রাণও ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী। সর্বত্র খাবারের জন্য তীব্র হাহাকার। আকাশ ছুঁয়েছে দাম। সংঘাতের আগের সময়ের তুলনায় ডিমের দাম বেড়েছে ১০ গুণ। আধা কেজি চিনির দাম বাংলাদেশের হিসাবে হাজার টাকার ওপরে (১০ ডলার)। খুঁজেও মেলে না তাজা ফল আর শাকসবজি।
প্রথম সাহ্রিতে রাফায় আশ্রয় নেওয়া সফটওয়্যার প্রকৌশলী হুসেইন ওউদা আর তাঁর পরিবারের সাত সদস্যের খাবার ছিল ২০০ গ্রামের কম পনির আর অল্প একটু রুটি। তা-ও পুরোটা খাননি তাঁরা। আর প্রথম ইফতারে পরিবারের জন্য মোলোখিয়া (একধরনের স্যুপ) জোগাড় করতে পেরেছিলেন সালেম বেতা। এক কেজি মোলোখিয়ার দাম পড়েছে প্রায় ৯০০ টাকা (৮ ডলার), আগের দিনে যা ছিল ১ ডলারের মতো।
রোজায় অনেকের অবস্থা আরও খারাপ। রাস্তায় রাস্তায় আবর্জনা হাতড়াতে দেখা গেছে অসহায় শিশুদের—যদি উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার পাওয়া যায়। উত্তর গাজার রাওয়ান্দ আলতাতারসহ অনেকের ভাষ্য, ‘শুধু রমজান নয়, বলতে গেলে প্রায় ছয় মাস ধরেই আমরা রোজা রাখছি।’
গাজায় আগের রমজানে সন্ধ্যার পর থেকেই কাতারে কাতারে মানুষ মসজিদের পথ ধরতেন। নারী–পুরুষ সবাই। একসঙ্গে তারাবিহর নামাজ আদায় করতেন। মহল্লার ঘরবাড়ি থেকে ভেসে আসত পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের সুর। টেলিভিশনে দেখা হতো রমজানের অনুষ্ঠান। এবারের রমজানে সন্ধ্যা হলেই ছড়িয়ে পড়ছে এক অজানা আশঙ্কা। কখন ধেয়ে আসে ইসরায়েলের বোমা। সন্ধ্যার পর গাজার বাসিন্দারা এবার বাইরে বের হচ্ছেন না তেমন। এ যেন এক অলিখিত সূর্যাস্ত আইন।
গাজাবাসী তারাবিহর নামাজ আদায় করবেনই-বা কোথায়। মসজিদ বলতে গেলে আর নেই। গত প্রায় ছয় মাসে হাজারের বেশি মসজিদ ইসরায়েলের বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। হামলার আশঙ্কায় এখন অল্প কয়েকজন খোলা আকাশের নিচে তারাবিহ আদায় করছেন। অজু করার জন্য পরিষ্কার পানিও পাচ্ছেন না তাঁরা।
এত নিপীড়ন, এত দুর্দশার মধ্যেও পবিত্র এ মাসে কোনো অভিযোগ নেই গাজাবাসীর। যেমন রাফায় আশ্রয় নেওয়া ৪৫ বছর বয়সী সাবাহ বেতা। তিনি দোয়া করছিলেন, ‘হে আল্লাহ, সব জাহানের মালিক, সবকিছু জন্য আপনার কাছে শুকরিয়া।’
তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, এনবিসি নিউজ