গাজায় ঢুকেছে ইসরায়েলি ট্যাংক, প্রতিরোধের দাবি হামাসের

গাজায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুত বিপুল পরিমাণ ইসরায়েলি ট্রাংক
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের গাজা সিটির উপকণ্ঠে ঢুকে পড়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণের সহায়তায় আজ সোমবার সালাহউদ্দিন সড়কে ঢুকে পড়ে ট্যাংকগুলো। এ সময় হামাসসহ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু হয়।

এদিকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় গত ২৪ দিনে ৮ হাজার ৩০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। নিহত ফিলিস্তিনিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার গাজা সিটির দক্ষিণ দিক থেকে জইতুন জেলায় ঢুকে পড়ে ইসরায়েলি ট্যাংক ও বুলডোজার। তা দিয়ে সালাহউদ্দিন সড়ক খুঁড়ে ফেলে গাজার দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরাংশকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

এ সময় ওই পথে কোনো গাড়ি চলাচল করতে গেলেই ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। এতে তিনজন নিহত হয়েছেন বলে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন বাসিন্দা জানান, ইসরায়েলি বাহিনী সালাহউদ্দিন সড়ক কেটে চলাচল অনুপযোগী করে ফেলেছে।

আরও পড়ুন

গাজার উত্তরাঞ্চলে ১০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির বসবাস। বেশ কয়েকবার তাঁদের ওই এলাকা ছেড়ে যেতে বলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত কয়েক দিনে বড়সংখ্যক বাসিন্দা উত্তর গাজা ছেড়ে গেছেন। তবে এখনো সেখানে হাজার হাজার বাসিন্দা রয়ে গেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

গত শুক্রবার গাজায় বড় পরিসরে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। পরদিন সেখানে আরও সেনা পাঠানো হয়। এরপর গতকাল গাজা সিটির উপকণ্ঠে ঢুকে পড়ে ইসরায়েলি ট্যাংক। উত্তর দিক থেকে গাজার প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। বিমান হামলায় বিধ্বস্ত বিভিন্ন ভবনে ইসরায়েলি স্নাইপারদের অবস্থান নিতে দেখা যায়।

স্থল অভিযানের পরিসর আরও বাড়ছে বলে গতকাল নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র দানিয়েল হাগারি।

এদিকে গাজায় ঢুকে পড়া ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে তুমুল লড়াই চলছে বলে জানিয়েছে হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডস। সালাহউদ্দিন সড়কে ঢুকে পড়া ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে বলেও দাবি করেছেন গাজার হামাস সরকারের প্রধান।

আরও পড়ুন

তথ্য দপ্তরের পরিচালক সালামা মারুফ প্রেরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, গাজা উপত্যকার আবাসিক এলাকাগুলোতে কোনোভাবেই অগ্রসর হতে পারেনি। সালাহউদ্দিন সড়কে যেটা হয়েছে, দখলদার বাহিনীর কয়েকটি ট্যাংক ও বুলডোজার অনুপ্রবেশ করেছিল।

বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিরোধযোদ্ধারা পাল্টা হামলা চালিয়ে পিছু হটিয়ে দেওয়ার আগে এসব ট্যাংক সালাহউদ্দিন সড়কে দুটি বেসামরিক প্রাইভেট কারে হামলা চালায়। বর্তমানে এই সড়কে দখলদার বাহিনীর কোনো সাঁজোয়া যান নেই। সড়কে চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

৫,৫৯৩ নারী-শিশু নিহত

৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৩০৬ জন নিহত হয়েছেন বলে গতকাল জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাঁদের মধ্যে ৩ হাজার ৪৫৭ জন শিশু আর ২ হাজার ১৩৬ জন নারী। এ ছাড়া বয়োবৃদ্ধ রয়েছেন ৪৮০ জন। পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন ১১৯ ফিলিস্তিনি।
এ ছাড়া ১ হাজার ৯৫০ জনের মতো নিখোঁজ রয়েছেন, যাদের ১ হাজার ৫০ জনই শিশু। নিখোঁজ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতার কারণে মরদেহের চেয়ে আহতদের উদ্ধারে জোর দিচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা।

৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েলে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪০৫ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের তিন শতাধিক সেনা। এ ছাড়া নিজেদের বন্দীদের মুক্ত করে আনতে দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে গাজায় জিম্মি করে রেখেছেন হামাস যোদ্ধারা। এসব জিম্মির বেশ কয়েকজনের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে।

আরও পড়ুন

‘ত্রাণ সরবরাহে বাধা অপরাধ’

ইসরায়েলের বিরামহীন বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে গাজার সর্বত্রই এখন ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। সড়ক ক্ষতবিক্ষত আর গুঁড়িয়ে দেওয়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ। মানুষের মাঝে আতঙ্ক আর টিকে থাকার মরিয়া ভাব।

জীবন বাঁচাতে উত্তর গাজার জাবালিয়া থেকে দক্ষিণে সরে এসেছেন ৫৩ বছর বয়সী ইব্রাহিম শানদোগলি। দক্ষিণেও বোমা হামলা সত্ত্বেও কেন তিনি এখানে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনিই বলুন আমরা কোথায় যাব? পুরো এলাকাই ঝুঁকিপূর্ণ।’
দক্ষিণে সরে আসা বাসিন্দাদের আরেকজন ইতিদাল আল-মাসরি। সীমান্তবর্তী শহর রাফাহতে এসেও খাবার, পানি ও ওষুধের সংকটে ভুগছেন এই নারী।

মাসরি বলেন, ‘গাজায় এখন রুটির জন্য, শৌচাগারে যেতে এমনকি ঘুমাতেও বাসিন্দাদের লাইনে দাঁড়াতে হয়।’

গতকাল রোববার খাবারের অভাবে থাকা লোকজন মরিয়া হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, কয়েক হাজার মানুষ খাবার, আটা ও তেলের জন্য জাতিসংঘ পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রে হামলে পড়ে। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

গাজায় দিনে ১০০ ট্রাক ত্রাণের প্রয়োজন বলে ত্রাণ সংস্থাগুলো জানিয়েছে। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজার বাসিন্দাদের ত্রাণসহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু সংঘাত শুরুর পর ত্রাণ সরবরাহে বাধা দিয়ে আসছে ইসরায়েল। গত ২৪ দিনে গাজায় কেবল শতাধিক ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকতে পেরেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম খান রোববার ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘জেনেভা কনভেনশনে স্বীকৃত ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেওয়া আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।’

আরও পড়ুন

রেহাই পাচ্ছে না মসজিদ-গির্জা-বিদ্যালয়

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৭টি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। হামলা হয়েছে সাতটি গির্জায়ও। গাজার সরকারি কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে। এ ছাড়া গত তিন সপ্তাহে সেখানে ২০৩টি বিদ্যালয় ভবনে হামলা হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৮০টি সরকারি দপ্তর।

তথ্য দপ্তরের পরিচালক সালামা মারুফ আরও বলেন, ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে ২ লাখ ২০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে অন্তত ৩২ হাজার আবাসিক ভবন।