মৃত্যুর বিভীষিকা চলছেই, ২৪ ঘণ্টায় নিহত ৩৫০

এই বাড়িতেই বসবাস করতেন তাঁরা। ইসরায়েলি বোমায় ভবনটি গুঁড়িয়ে যাওয়ার পর সেখানে এসেছেন হতভাগ্য এই ফিলিস্তিনিরা। গতকাল দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে
ছবি: এএফপি

‘আমার ছেলের বয়স পাঁচ বছর। ক্ষুধার তাড়নায় সে আমার কাছে খাবারের আবদার করে। সে বোঝে না, বাবা আরও বেশি ক্ষুধার্ত।’ কথাগুলো বলছিলেন ফিলিস্তিনের গাজার খান ইউনিস এলাকার একটি হাসপাতালের চিকিৎসক নাসের। পেটে ক্ষুধা নিয়েই দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন এই চিকিৎসক। এরপরও দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে পারলেই তা তুলে দিচ্ছেন সন্তানের মুখে।

নাসেরের বক্তব্যে উঠে এসেছে ইসরায়েলি হামলার জেরে গাজায় সৃষ্টি হওয়া ভয়াবহ সংকটের একটি চিত্র মাত্র। উত্তর থেকে দক্ষিণ—পুরো গাজাই এখন মুহূর্তে মুহূর্তে কেঁপে উঠছে বোমার বিকট শব্দে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফিলিস্তিনিদের লাশের সারি, আহত ব্যক্তিদের আর্তনাদ। চারদিকে বাস্তুচ্যুতদের দুর্দশা আর খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে মানুষের হাহাকার।

গতকাল শুক্রবার গাজাবাসীর এ হাহাকার আরও বেড়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী এদিন উপত্যকাটিতে ৪৫০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।

২৪ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির পর থেকে এক দিনে এত জোরদার হামলা চালায়নি ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় আগের দিন বৃহস্পতিবার ৩৫০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। আর সংঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত উপত্যকাটিতে মারা গেছেন ১৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। আহত ৬০ হাজার। নিহত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। একই সময়ে পশ্চিম তীরে হামলায় নিহত হয়েছেন ২৭০ জন।

কোথাও হামলা বাদ নেই

গতকাল গাজার সর্বত্রই ইসরায়েলের বিমান হামলার শিকার হয়েছে। মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে হামলায় বেশ কয়েকটি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস, জউরাত আল–আকাদ ও আল–মাহাত্তা সড়কের কাছে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো। বাদ পড়েনি মিসর সীমান্তবর্তী এলাকা রাফাহও। পূর্ব গাজায় শুজাইয়া এলাকায় বোমার আঘাতে অনেকে হতাহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা।

মধ্য গাজার দেইর আল–বালাহ এলাকায় বিমান হামলার পর সেখানকার আল–আকসা হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের ভিড় দেখা গেছে। রোগীর চাপে সেখানে মেঝেতেও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এর আগে হাসপাতালটির আশপাশের এলাকায় বোমা হামলা চালানো হয়। তাতেও হতাহত হন অনেকে।

এদিকে জেনেভাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইউরো–মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের প্রধান রামি আবদু জানিয়েছেন, গতকাল ওমারি মসজিদ নামে গাজার সবচেয়ে পুরোনো ও বড় একটি মসজিদে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। বোমার আঘাতে হাজার বছরের পুরোনো এ মসজিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস জানিয়েছে, গাজার শুজাইয়া এলাকায় তাদের যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাদের তুমুল লড়াই চলছে। খান ইউনিসেও হামাসের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন ইসরায়েলের সেনারা। এ দুই এলাকায় সংঘর্ষের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীও।

‘এভাবে আর কত দিন’

গত অক্টোবরের শেষ দিকে উত্তর গাজায় স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। তখন সেখান থেকে বাসিন্দাদের চলে যেতে বলা হয়েছিল। সম্প্রতি দক্ষিণ গাজায় অভিযান শুরুর আগেও সেখান থেকে সবাইকে সরে যেতে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য বলছে, গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকেই নিজ ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছে।

ইসরায়েলের হুমকির মুখে রাফাহতে আশ্রয় নিয়েছেন তহায়ের কাদিহের মতো বাস্তুচ্যুতদের অনেকেই। ত্রিপলের তৈরি একটি তাঁবুতে পরিবার নিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। কাদিহ বলেন, ‘আমরা ঘুমাতে পারি না। ভয়, ক্ষুধা আর শীতে আমরা কাবু হয়ে পড়েছি। কেউ আমাদের দুর্দশার দিকে তাকাচ্ছে না।’ আর মধ্য গাজার একটি স্কুলে পরিবারসহ আশ্রয় নেওয়া ইয়েমেনের প্রশ্ন, ‘প্রতিদিন আমরা বলি, কোনোমতে আজ বেঁচে গেলাম। কিন্তু এভাবে আর কত দিন চলবে?’

এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান থমাস হোয়াইটের শঙ্কা, ‘গাজায় গৃহযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে।’

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারা প্রয়োগের পর গতকাল নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের তোলা ‘গাজায় দ্রুত যুদ্ধবিরতির’ প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হওয়া কথা। তবে দিবাগত রাত একটা পর্যন্ত ভোট শুরু হয়নি। ভোটের আগেই ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র।

এদিকে নতুন যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করলেও গাজার বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষার দিকে নজর দিতে ইসরায়েলকে আবারও আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন। বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষায় ইসরায়েল যা বলছে এবং যা করছে, তাতে ফারাক দেখা যাচ্ছে।