ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতা
পিঠে গুলিবিদ্ধ অনেকগুলো মরদেহ মাটিতে পড়ে ছিল
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী গত ডিসেম্বরে কীভাবে ১৯ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, তা উঠে এসেছে ভিডিও চিত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে
ফিলিস্তিনের গাজায় গত ডিসেম্বরে অন্তত ১৯ জন বেসামরিক নাগরিককে ‘ঠান্ডা মাথায় হত্যা’ করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফিলিস্তিনি নারীদের নির্যাতন–মারধরও করছে ইসরায়েলি সেনারা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও হত্যার ঘটনার ভিডিও চিত্র দেখে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফিলিস্তিনিদের ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যার এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নথিবদ্ধ করার কাজ করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এদিকে আল–জাজিরা গত ১৯ ডিসেম্বরের একটি ঘটনার বিষয়ে এক পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা ও সেই ঘটনার ভিডিও চিত্র পেয়েছে।
ইসরায়েলি সেনারা গত মাসে যে ফিলিস্তিনিদের এভাবে হত্যা করেছে, তাদের একজন ছিলেন উম ওদাই সালেমের স্বামী। ওদাই সালেম আল–জাজিরাকে বলেন,‘(ইসরায়েলি সেনারা) ট্যাংক ও বুলডোজার নিয়ে পুরো ভবন ঘিরে রেখেছিল। কয়েক দিন ধরে ভবনটি লক্ষ্য করে গোলা ছোড়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেনারা আমাদের দরজায় এসে চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু করে। আমার স্বামী তখন তাদের বলেন, ‘‘আমরা বেসামরিক নাগরিক’’। এরপরও তারা আমার স্বামীকে ধরে অন্য একটি ভবনে নিয়ে যায়। আমি তাদের পিছু পিছু যাই। তাদের কাছে আকুতি জানাই, ‘‘আমরা বেসামরিক, দয়া করে আমার স্বামীকে ছেড়ে দাও।”’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব ঘটনার তদন্ত কীভাবে হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের ঘটনা যেসব সংস্থা তদন্ত করতে পারে, তাদের কাউকে তো গাজায় প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জানিয়ে এই ফিলিস্তিনি নারী বলেন, ‘তারা (ইসরায়েলি সেনারা) আমাকে ও আমার মেয়েকে মারধর করে। আমাদের ধরে নিয়ে অন্য একটি জায়গায় রাখে। বন্দুক ও ছুরি দেখিয়ে হুমকি দেয়। আমাদের কাপড়চোপড় খুলতে বাধ্য করার পর তল্লাশি চালায়। বাজে ও অকথ্য ভাষায় আমাদের নানাভাবে গালিগালাজ করতে থাকে।’
উম ওদাই সালেম জানান, তাঁদের আকুতি সত্ত্বেও ইসরায়েলি সেনারা যেসব পুরুষকে ধরে নিয়ে এসেছিল, তাঁদের সবাইকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। সালেম বলেন, ‘ওই ভবনে যে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়, তাঁদের একজন ছিলেন আমার স্বামী।’
ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, অনেকগুলো মরদেহ মাটিতে পড়ে আছে। তাঁদের পিঠ বুলেটবিদ্ধ। সবাইকে গুলি করে হত্যার পর সালেম তাঁর মেয়েকে নিয়ে যে ভবনটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে গোলাবর্ষণ করতে শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। সালেমের এক মেয়ে বলেন, গোলার আঘাতে তাঁর তিন বছরের এক বোন মারা গেছে।
সালেমের মেয়ে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমার কোলে ছিল তিন বছর বয়সী বোন নাদা। গোলাবর্ষণ শুরু হলে তা নাদাকে আঘাত করে।’
লন্ডনের মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ের একজন অধ্যাপক উইলিয়াম শ্যাবাস। ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও নির্যাতন প্রসঙ্গে বললেন, ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বর্ণনা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) প্রমাণ হিসেবে উত্থাপনযোগ্য।
অধ্যাপক উইলিয়াম শ্যাবাস আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এই মানুষগুলো যে বেসামরিক নাগরিক, সেটা প্রমাণ করারও সত্যিকার অর্থে দরকার নেই। এমনকি যোদ্ধা ও যুদ্ধে অংশ নেওয়া কোনো সেনাকে এভাবে হত্যার ঘটনা যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য।’
ডেনমার্কের কোপেনহেগেনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইউরো–মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের মুহাম্মাদ শেহাদা মনে করেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের পদ্ধতিগতভাবে হত্যার ঘটনা ঘটছে।
ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী ও হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন।
গত ৭ অক্টোবর গাজায় নির্বিচার হামলা শুরুর পর ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের ধরে নিয়ে হত্যা করার অভিযোগ এর আগেও উঠেছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব ঘটনার তদন্ত কীভাবে হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের ঘটনা যেসব সংস্থা তদন্ত করতে পারে, তাদের কাউকে তো গাজায় প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নির্যাতন, নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে অনেক ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা থেকে। গত শুক্রবার ইসরায়েলি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন মুহাম্মদ আবু সামরা নামে এক ফিলিস্তিনি। তিনিও নির্যাতন ও মারধরের অভিযোগ করেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একজন কর্মকর্তা গত শুক্রবার জানান, গাজা উপত্যকা থেকে যাঁদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা, তাঁদের অনেককেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ অজানা স্থানে নিয়ে রাখা হচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এই ফিলিস্তিনিরা।