মধ্যপ্রাচ্যে কি যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিতে যাচ্ছে চীন
সাত বছর পর প্রথম ৬ এপ্রিল সৌদি আরব ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসলেন। এর এক মাস আগে দুই দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেন। দীর্ঘদিনের শত্রুতা ভুলে তাঁরা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।
মজার বিষয়, দুই দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বৈঠক মধ্যপ্রাচ্যে হয়নি। চীনের মধ্যস্থতায় তাঁরা বেইজিংয়ে বৈঠকে বসেছেন। এর আগে ওমান ও ইরাক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশীকে বৈঠকে বসাতে কয়েক বছর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বে এখন চীনের প্রধান ভূমিকা, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা। এমনকি ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও রাশিয়ায় ইউক্রেনের হামলা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতেও রাজি নয় চীন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত কিছুর পরও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় চীনের এই মুখ্য ভূমিকা তাদের জন্য বিরাট এক সাফল্য। অথচ ঐতিহাসিকভাবে চীন বৈশ্বিক সংঘাতে কখনো নিজেদের জড়াতে চায় না।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এটি চীনের অনেক বড় স্বপ্ন। ইরান–সৌদি বৈঠকের আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ‘সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সব মতপার্থক্য ও বিরোধের সমাধান’ শীর্ষক বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ ঘোষণা করেছিল বেইজিং।
গত সপ্তাহে আবার চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ঘোষণা দিলেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে বেইজিং প্রস্তুত।
জার্মানির আর্নল্ড–বার্গস্টেইসার–ইনস্টিটিউট ফ্রিবার্গের অ্যাসোসিয়েট ফেলো জুলিয়া গুরল–হলার বলেন, ‘সৌদি–ইরান চুক্তি চীনের “ভবিষ্যৎ উদ্যোগের মঞ্চ” হয়ে উঠতে পারে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, অতীতের তুলনায় এখন তারা যেকোনো সংঘাতে বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের এসব ঘোষণা এমন সময়ে এল, যখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু।
ঐতিহ্যগতভাবে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয়। এ ছাড়া ইরাক ও আফগানিস্তানে তাদের দীর্ঘ দখলদারত্ব এবং দুই দেশ থেকে হঠাৎ সেনা প্রত্যাহার তাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বৈশ্বিক পুলিশম্যান’–এর ভূমিকা নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যর্থতা সত্ত্বেও দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ভূমিকা রেখেছে, চীন কি সেটা পারবে?
‘সৌদি-ইরান চুক্তি চীনের ‘ভবিষ্যৎ উদ্যোগের মঞ্চ’ হয়ে উঠতে পারে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, অতীতের তুলনায় এখন তারা যেকোনো সংঘাতে বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে ‘না’। বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব দ্রুত বাড়লেও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। এ অঞ্চলে ওয়াশিংটনের হাজার হাজার সেনা ও সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং মিত্রদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বেইজিং এই দায়দায়িত্ব না–ও নিতে পারে। এ মুহূর্তে চীন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণ করতে পারে। নিরাপত্তা ইস্যুতে আগের মতোই নেতৃত্বের আসনে থাকতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
সৌদি আরব ও ইরানের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার চীন এবং এ দুই দেশের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতাও তারা। ২০২১ সালে ইরানের সঙ্গে ২৫ বছরের সহযোগিতা চুক্তি করে সম্পর্ককে আরও সংহত করেছে দেশটি। আবার ২০২২ সালে সৌদির সঙ্গে সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি করেছে এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির এ দেশ।
তবে সৌদি ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের এতটা বিস্তার হলেও এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্য সংযোগ তৈরি করতে ২০১৩ সালে চালু চীনের উচ্চবিলাসী অঞ্চল ও পথের উদ্যোগে (বিআরআই) নেই এই দুই দেশ। এ প্রকল্পের আওতায় বন্দর, রেলপথ ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।
২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে চীন এ অঞ্চলে ২৭ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই অঞ্চলে চীনের এটিই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। এর বাইরে ইরাক থেকে তেল ও কাতার থেকে গ্যাস কিনছে দেশটি। আবার আলজেরিয়া, মরক্কো, তুরস্ক, মিসর ও সৌদি আরবে অস্ত্র রপ্তানি করছে। কায়রোর বাইরে নতুন রাজধানী বানাতেও মিসরকে সহায়তা দিচ্ছে তারা। এ ছাড়া মক্কা নগরে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করেছে চীন।
‘আমার মনে হয় না, চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উৎখাত করতে চায়। কারণ, এখানে যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু কাজ করে, যা করতে চীন মোটেই পছন্দ করে না’
২০২২ সালের ডিসেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং তিন দিনের সফরে সৌদি আরবে যান। এ সময় তিনি প্রথমবারের মতো আরব লিগ ও উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলন করেছেন। সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান চীনা প্রেসিডেন্টের সফরকে ‘নতুন যুগের সূচনা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইতিমধ্যে বেইজিং এ অঞ্চলে হুয়েই কোম্পানির মাধ্যমে পঞ্চম প্রজন্মের মুঠোফোন সেবা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্র্যাফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, সব মিলিয়ে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব স্বয়ংক্রিভাবে বেড়ে যাবে। এই প্রভাব সৌদি ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চীনকে সফল করে তুলতে পারে। এই অঞ্চলের সব দেশ–ই অর্থনৈতিক কারণে চীনের সহায়তা চায়।
এমনকি মধ্যপ্রাচ্য আদর্শিকভাবে চীনকে নিরপেক্ষ অংশীদার মনে করে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনীতি থেকে মানবাধিকার ইস্যুসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন কখনো নাক গলায়নি। এখানেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের কাছে অনেক বেশি পছন্দের।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই চীনের। এ ছাড়া এই অঞ্চলের কোনো দেশের ওপর সামরিক হস্তক্ষেপ বা নিষেধাজ্ঞার মতো কোনো ইতিহাসও দেশটির নেই।
ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা
সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্ট স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফ্যান হোংগদা বলেন, একই সময়ে চীন নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে।
এই অধ্যাপক বলেন, প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক প্রভাব বিশেষ করে বিআরআইয়ের মতো প্রকল্পের মধ্যে চীনের ক্ষমতা নিহিত। এ অঞ্চলে এই প্রভাব ধরে রাখতে পারলেই চীন এখন খুশি।
ফ্যান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ইচ্ছাই চীনের নেই। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না, চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উৎখাত করতে চায়। কারণ, এখানে যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু কাজ করে, যা করতে চীন মোটেই পছন্দ করে না। সোজা কথায় বলতে গেলে, চীন তার নিজস্ব ঢঙে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সহযোগিতা করতে চায়।’
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের মতো ঘটনায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অন্যের প্রতিপক্ষ ছিল। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে বেইজিং কেবল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীন সব সময় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার নীতি বজায় রেখে চলেছে। কোনো দেশে সরকার পরিবর্তন বা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাতের কোনো নজির চীনের নেই, যেমনটা করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত তিন ডজন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
২০১৭ সালে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি দেশের বাইরে প্রথম হরমুজ প্রণালির কাছে জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি করেছিল। এর চার বছর পর ওয়াল স্টিট জার্নাল প্রতিবেদন করেছিল, সংযুক্ত আরব আমিরাতে চীন নৌঘাঁটি করে থাকতে পারে। তবে চীনা পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বেইজিং ‘প্রথম বেসামরিক, পরে সামরিক’ নীতি অনুসরণ করে থাকে। বিভিন্ন দেশে বন্দর, রেললাইন, বিমানবন্দরের মতো অবকাঠামো তৈরিতে চীনের আগ্রহ বেশি।
তেহরান সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের চায়না–মিডল ইস্ট প্রজেক্টের পরিচালক জাকিয়া ইয়াজদানেশনাস বলেন, এখনো চীনের রেকর্ড হচ্ছে এমনই যে এ অঞ্চলে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে নিজেকে জড়াতে আগ্রহী নয়। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সামরিক উপস্থিতির বিষয়ে বেইজিংয়ের না আছে সামর্থ্য, না আছে আকাঙ্ক্ষা।
সীমিত প্রভাব
লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অ্যাসোসিয়েট ফেলো মার্ক ফিৎজপ্যাট্রিক বলেন, ‘পুলিশম্যান’ বা নিরাপত্তা জোগানদার হিসেবে ভূমিকা নিতে চীনের অনাগ্রহের কারণে দীর্ঘমেয়াদে চীনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা সীমিত হয়ে যেতে পারে।
চীন কেবল অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার গ্যারান্টি দিয়ে সৌদি ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে কি না, তা দেখার বিষয়। মার্ক বলছেন, চীন যদি কেবল অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাজটি করে, তাহলে এর স্থায়িত্ব নিয়ে মানুষের মনে সংশয় থাকবে।
জার্মানির আর্নল্ড-বার্গস্টেইসার-ইনস্টিটিউট ফ্রিবার্গের অ্যাসোসিয়েট ফেলো জুলিয়া গুরল-হলার বলেন, এখন চীনকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপ্রতিষ্ঠা এবং দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত এড়াতে ‘দীর্ঘ ও বন্ধুর’ পথ পাড়ি দিতে হবে। সৌদি আরব ও ইরানকে নিয়ে চীন কীভাবে এই পথ পাড়ি দেবে, সেটা পরিষ্কার নয়। কোনো পক্ষ চুক্তির লঙ্ঘন করলে কীভাবে মোকাবিলায় করা হবে, যৌথ ঘোষণায় সেটার উল্লেখ নেই।
জুলিয়া বলেন, ‘সুতরাং, ইরান যদি চুক্তির কোনো অংশ লঙ্ঘন করে, তাহলে কি হবে? আবার সৌদি আরব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করলে তারই–বা কী হবে? এসব ক্ষেত্রে চীন কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তার কোনো কিছুই আসলে পরিষ্কার নয়। এর শাস্তি বা পুরস্কার কী—তার কোনো কিছুই নেই যৌথ ঘোষণায়।’
জুলিয়া আরও বলেন, তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কঠিন যাত্রা কেবল শুরু হলো।