প্রতিশোধ নিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, জবাব দেওয়ার হুমকি ইসরায়েলের
ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ১৮০টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। মঙ্গলবার ইরান এ হামলা চালায়। এ হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ইসরায়েল সরকার। হামলার সময় লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশটির আকাশসীমা। বাংকারে আশ্রয় নেন ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার সদস্যরা।
লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার মধ্যে ইরান ইসরায়েলে এ হামলা চালাল। গত সোমবার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। পাশাপাশি ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। হামলায় সোমবার এক দিনেই লেবাননে ৯৫ জন নিহত হয়েছেন।
এর আগে শুক্রবার বৈরুতের উপকণ্ঠে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। গত বছরের অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে সীমিত পরিসরের হামলা চালিয়ে আসছিল ইরানের সমর্থনপুষ্ট সংগঠন হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলও পাল্টা জবাব দিচ্ছিল। গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে লেবাননে হামলা জোরদার করে ইসরায়েল।
মূলত গত অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে বোমা হামলা চালিয়ে ইরানের এলিট ফোর্স ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) একজন কমান্ডারকে হত্যা করে ইসরায়েল। এর জবাবে ইরান এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সেটিই ছিল ইরান থেকে সরাসরি ইসরায়েলি হামলার প্রথম ঘটনা। গত ৩১ জুলাই ইরানের হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে ইসরায়েল। সর্বশেষ হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা ছিল ইরানের জন্য বড় ধাক্কা।
কিছু ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে
মঙ্গলবার রাতে তেল আবিবসহ ইসরায়েলি শহরগুলো লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানানো হয়। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও আইআরজিসি কমান্ডার আব্বাস নিলফোরোশনকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে আইআরজিসি জানিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা এ তথ্য দিয়েছে।
বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করলেও মধ্য ও দক্ষিণ ইসরায়েলে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানে। তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ পড়ে দুজন আহত হওয়ার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা বিভাগ। এ ছাড়া আরও কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছেন।
এদিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কিছুক্ষণ আগে তেল আবিবে পৃথক বন্দুকধারীর হামলায় আটজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় দুই বন্দুকধারীও নিহত হন।
আইআরজিসি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েল এ হামলার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলে ‘ধ্বংসাত্মক হামলা’ চালিয়ে জবাব দেবে ইরান।
সিএনএন জানায়, ইসরায়েলে হামলা শুরুর পরপরই আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। বাংকারে আশ্রয় নেন ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার সদস্যরা। এ ছাড়া ইসরায়েল ও ইরানের মাঝামাঝি অবস্থানরত ইরাক ও জর্ডানও তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়।
হামলা ঠেকাতে নির্দেশ বাইডেনের
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীকে নির্দেশ দেন বাইডেন।
এদিকে ইসরায়েল এ হামলার জবাব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল দানিয়েল হাগারি। তিনি বলেন, ‘এ হামলার জন্য পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে। আমরা যথাস্থানে ও যথাসময়ে হামলার সিদ্ধান্ত নেব।’
ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়ে হাগারি বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছি। তবে মধ্য ও দক্ষিণ ইসরায়েলে আরও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। এ পর্যায়ে আমরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি। আহতের কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’
এদিকে ইসরায়েলে চালানো হামলাকে ‘বৈধ ও যৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী মিশন। হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে পাল্টা হামলার বিষয়েও ইসরায়েলকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। পাল্টা হামলা চালালে ইরান তার জবাব দেবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরানি মিশন।
যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েই লেবাননে স্থল অভিযান
আল-জাজিরা খবরে বলা হয়, লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে সোমবার দেশটিতে ঢুকে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। পাশাপাশি ওই অঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলি হামলায় সোমবার এক দিনেই ৯৫ জন নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গতকাল এক বিবৃতিতে জানায়, দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে কয়েক ঘণ্টা আগে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে স্থল বাহিনী প্রবেশ করেছে।
তবে ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ঢোকেনি বলে দাবি করেছে হিজবুল্লাহ। সংগঠনটির গণমাধ্যম শাখার কর্মকর্তা মুহাম্মদ আফিফ আল-জাজিরাকে বলেছেন, দখলদার (ইসরায়েলি) বাহিনী লেবাননে প্রবেশের দাবি মিথ্যা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় সোমবার এক দিনে ৯৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৭২ জন। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
ইসরায়েলের হামলার জবাবে রকেট ছুড়েছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল, দখলকৃত গোলান মালভূমি লক্ষ্য করে রকেট ছোড়া হয়। ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ শহর তেল আবিবের কাছে একটি মহাসড়কে একটি রকেট আঘাত হানলে এক ইসরায়েলি আহত হন।
লেবাননের পাশাপাশি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে তিনজন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম। এ হামলায় আহত হয়েছেন নয়জন।
‘ছোট পরিসরে’ অভিযান
সোমবার মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাতে সিএনএনের খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী লেবাননের দক্ষিণের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সোমবার সকালে ছোট পরিসরে বিশেষ ‘অভিযান’ পরিচালনা করেছে। তাঁদের একজন বলেন, ‘খুবই ছোট আকারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে অভিযান চালানো হয়েছে। বিষয়টা এমন, আপনি সীমানা পেরিয়ে গিয়ে অভিযান চালিয়ে আবার ফিরে এসেছেন।’
পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, লেবাননে অভিযানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করেছে ইসরায়েল। তিনি আরও বলেন, সীমান্ত এলাকায় হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে ছোট পরিসরে অভিযান চালানো হয়েছে।
সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান রাশিয়ার, হামলার নিন্দা চীনের
লেবাননের ভূখণ্ড থেকে ‘অনতিবিলম্বে’ সেনা প্রত্যাহার করতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, গতকাল এক বিবৃতিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আহ্বান জানায়।
এ ছাড়া ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে চীন। আল-জাজিরা জানায়, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, লেবাননের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধিতা করে চীন।