১০৩ স্বজন হারানো আহমাদ বললেন, ‘কে আমায় বাবা ডাকবে?’
‘কে আমায় বাবা বলে ডাকবে? কে বলবে প্রিয়তম? গাজায় আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে? কার জন্য সেখানে ফিরে যাব?’—এমন জিজ্ঞাসা ফিলিস্তিনের গাজা নগরীর বাসিন্দা আহমাদ আল-ঘুফরির।
ইসরায়েলের এক বিমান হামলায় মা, স্ত্রী, সন্তানদের হারিয়েছেন আহমাদ। ওই হামলায় আহমাদের ১০৩ জন স্বজনের প্রাণ গেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯৮ বছরের প্রবীণ থেকে ৯ দিন বয়সী শিশু রয়েছে।
গত ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হামলার ঘটনা ঘটে। ইট–পাথরের নিচে চাপা পড়ে আহমাদের পুরো পরিবার। ওই সময় সেখান থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেরিকো শহরে ছিলেন আহমাদ। জেরিকোয় তিনি একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
আহমাদ জানান, গত ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরুর পর থেকে তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেন। তবে ঠিকঠাক নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় অনেক সময় কথা বলা সম্ভব হতো না।
স্বজন হারানো আহমাদ বলেন, ‘ঘটনার সন্ধ্যায় আমার চাচার চারতলা বাড়ির ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান চক্কর দিতে থাকে। আমি তখন মুঠোফোনে স্ত্রী শিরিনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন শিরিন ক্ষমা চেয়ে বলে, “কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা করে দিয়ো। আমরা নিশ্চিত মারা যাব।” জবাবে তাকে বলেছি, ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এটাই ছিল আমাদের শেষ কথোপকথন।’
ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রাণ যাওয়া ১০৩ জন স্বজনের মধ্যে আহমাদের স্ত্রী শিরিন ও ছোট তিন মেয়ে—তালা, লানা ও নাজলা রয়েছে।
স্ত্রী-সন্তান-স্বজনদের মরদেহ দেখতে পারেননি আহমাদ। এর কারণ, ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীর অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। জেরিকো থেকে গাজা নগরীতে যেতে পারেননি আহমাদ। তিনি এখনো জেরিকোতেই আছেন।
আহমাদ বলেন, হামলার ঘটনার দুই মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এখনো অনেক স্বজনের মরদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। সবশেষ হামলার ৭৫ দিনের মাথায় চারজন স্বজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর ওই হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আহমাদের এক দাদি। তাঁর বয়স ৯৮ বছর। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও আছেন আহমাদের মা, চার ভাই ও তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা, ফুফু, চাচা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও।
হামলা থেকে বেঁচে গেছেন আহমাদের স্বজন হামিদ আল-ঘুফরি। তিনি বিবিসিকে বলেন, যখন বিমান হামলা শুরু হয়, তখন যাঁরা পাহাড়ের দিকে দৌঁড়ে পালিয়ে যান, তাঁরা প্রাণে বেঁচে গেছেন। যাঁরা ভবনের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই মারা গেছেন।
বিমান হামলা চালিয়ে সেখানকার চারটি বহুতল ভবন ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১০ মিনিট পরপর ভবন ৪টিতে বিমান হামলা চালানো হয় বলেও জানান হামিদ আল-ঘুফরি।
আহমাদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে নাজলার জন্মদিন ছিল গত সপ্তাহে। বেঁচে থাকলে শিশুটি দুই বছরে পা রাখত। সন্তান হারানো আহমাদ এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, কেন তাঁর পরিবারকে এত চড়া মূল্য দিতে হলো। কেননা, পরিবারটির সঙ্গে হামাসের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। পরিবারের সদস্যদের সবাই ছিলেন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক।
কান্নাভেজা কণ্ঠে আহমাদ বলেন, ‘আমার মেয়েরা ছিল ছোট্ট পাখির মতো। আমার এখনো মনে হয়, আমি একটি দুঃস্বপ্ন দেখছি। আমার জীবনে যা ঘটে গেল, তা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।’
সন্তানদের ছবি দেখলেই মুষড়ে পড়েন আহমাদ। কিছুতেই তিনি শোক সামাল দিতে পারেন না। মর্মযাতনা থেকে বাঁচতে তিনি সন্তানদের ছবি মুঠোফোন ও ল্যাপটপের পর্দা থেকে সরিয়ে ফেলেছেন। এরপরও স্ত্রী-সন্তান-স্বজন হারানোর শোক তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।