নিজের নকশায় মধ্যপ্রাচ্যকে সাজাতে চাইছে ইসরায়েল
সিরিয়ায় বাশার আল–আসাদের নাটকীয় পতনের পরপরই দেশটিতে ব্যাপক হামলা শুরু করেছে প্রতিবেশী ইসরায়েল। এ হামলার সঙ্গে নিজেদের সুরক্ষা জড়িত বলে দাবি করেছে তারা। তবে সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার ঘটনা নতুন নয়। বলতে গেলে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকেই দেশটিতে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইসরায়েলের ওই হামলা ছিল সিরিয়ার সামরিক বাহিনীর অস্ত্রের বহরের ওপর। তাতে দুজন নিহত হন। তারপর দেশটিতে ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া হামলার পেছনে একটি অজুহাত দেখিয়ে আসছে ইসরায়েল। সেটি হলো সিরিয়ায় ইরান ও দেশটির সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে তারা।
‘সুযোগসন্ধানী’ ইসরায়েল
গত রোববার বাশার আল–আসাদের পতনের পর কয়েক দিনে সিরিয়াজুড়ে পাঁচ শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। একই সময়ে তারা সিরিয়া–ইসরায়েল সীমান্তে গোলান মালভূমির বাফার জোন বা নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চলের দখল নিয়েছে। ইসরায়েলের ভাষ্য, ১৯৭৪ সালে যে চুক্তির ভিত্তিতে এই বাফার জোন গড়ে তোলা হয়েছিল, তা ‘ব্যর্থ’ হয়েছে। এখানে তারা এখন ‘সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা অঞ্চল’ সৃষ্টি করতে চায়।
বাশারের পতনের অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)। এতে তাদের সময় লেগেছে মাত্র ১২ দিন। এ অল্প সময়ে বাশারের ক্ষমতা হারানোর কৃতিত্ব নিয়েছেন ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গত সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ইসরায়েলের হামলার কারণে হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরান দুর্বল হয়েছে। বাশারের পতনের পেছনে এর সরাসরি প্রভাব রয়েছে।
অল্প সময়ে বাশার আল–আসাদের ক্ষমতা হারানোর কৃতিত্ব নিয়েছেন ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
সিরিয়ায় ইসরায়েল যে হামলা চালাচ্ছে, তার পেছনে দেশটির সুযোগসন্ধানী মনোভাব ও কৌশল রয়েছে বলে মনে করেন ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মাইরাখ জোনসজেইন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাস্তবে আমরা ইসরায়েলে এমন একটি কৌশল দেখতে পাচ্ছি, যা তারা গত বছরের অক্টোবরের ৭ তারিখ থেকে বাস্তবায়ন করছে। সেটি হলো একটি হুমকি বা সুযোগ শনাক্ত করা, তারপর সেখানে সেনা মোতায়েন করা এবং হুমকি নির্মূল করা বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করা।’
তবে ইসরায়েলের কৌশলের বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে ইসরায়েলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওরি গোল্ডবার্গের। তেল আবিব থেকে তিনি বলেন, সিরিয়ায় ইসরায়েল যে হামলা চালাচ্ছে, তা দেশটির নতুন নিরাপত্তা নীতি অনুযায়ী হচ্ছে। মানুষজন বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। তবে এমন কিছু দেখছেন না তিনি। তাঁর মতে, সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার পেছনের বড় কারণ দেশটিতে চলমান বিশৃঙ্খলা।
বৈশ্বিক নিন্দায় কান দিচ্ছে না ইসরায়েল
গত ১৪ মাসে ইসরায়েল অন্তত ৪৮ হাজার ৮৩৩ জনকে হত্যা করেছে। তারা ইরানে হামলা চালিয়েছে। লেবাননে ইরান–সমর্থিত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ওপর আঘাত হেনেছে। আর এখন সিরিয়া তছনছ করছে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েল। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী জাতিগত নিধনে জড়িয়েছে বলে অভিযোগ এনেছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা।
এ বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর; বরং ‘মধ্যপ্রাচ্যের রূপ বদলে দেওয়ার’ যে কথা তিনি বলেছেন, তা ইসরায়েলের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ করা হচ্ছে। বুধবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য জেরুজালেম পোস্টের এক মতামতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, গত বছরে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যে স্থিতিশীলতা এনেছে, তা দশকের পর দশক ধরে চেষ্টা করেও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও পশ্চিমা কূটনীতিকেরা আনতে পারেননি।
বাশারের পতনের পর নতুনভাবে স্বাধীন সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে মিসর, ফ্রান্স, ইরান, ইরাক, কাতার, রাশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ। ২২ সদস্য দেশের জোট আরব লিগও এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর সুযোগ নিচ্ছে ইসরায়েল।
গত বুধবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য জেরুজালেম পোস্টের এক মতামতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, গত বছরে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যে স্থিতিশীলতা এনেছে, তা দশকের পর দশক ধরে চেষ্টা করেও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও পশ্চিমা কূটনীতিকেরা আনতে পারেননি।
সিরিয়া–ইসরায়েল সীমান্তের বাফার জোনের দেখভাল করার দায়িত্ব জাতিসংঘের। ইসরায়েল এই অঞ্চল দখলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবাদের কোনো অর্থ নেই। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ও অপরাধ আদালতকে বলতে চাই, তাঁদের আমরা তোয়াক্কা করি না। আমরা যা চাই, তা–ই করব।’
বুধবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের কলাম লেখক জেফরি লেভিন বলেছেন, বিগত ১৩ মাসে ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির নতুন একটি মধ্যপ্রাচ্যের’ দিকে অগ্রগতি হয়েছে। গত বছর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিবর্তন এসেছে, তার ভিত্তিতে লেভিনের ভবিষ্যদ্বাণী হলো—আসাদ পরিবারের ভূরাজনৈতিক কৌশল থেকে মুক্তি পাবে সিরিয়া; ‘ধর্মতান্ত্রিক শাসন’ থেকে মুক্তি পাবে ইরান, কুর্দিরা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে এবং জর্ডানে নিজেদের একটি নতুন দেশ গড়ে তোলার স্বাধীনতা পাবেন ফিলিস্তিনিরা।
বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ভাবছেন ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিমরোদ ফ্ল্যাশেনবার্গ। তিনি বলেন, ‘এত কিছুর পরও ইসরায়েলিরা এই অঞ্চলে (মধ্যপ্রাচ্য) জনপ্রিয় হওয়ার কথা ভাববেন বলে আমি মনে করি না। তবে আমি এমন এক মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে আশাবাদী, যেখানে ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবপন্ন দেশ তুলনামূলক কম থাকবে।’