ইরানের ইসলামি বিপ্লবের এক বছর পর থেকে ইরানের প্রেসিডেন্সি একটি অদ্ভুত প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে ইরানের প্রথম দিকের প্রেসিডেন্টরা বিশ্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন। তবে তাঁরা খুব কমই সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালে খোমেনির মৃত্যুর পর ইরানের প্রেসিডেন্টরা নিজেদের একটি গণতান্ত্রিক ইরানের আন্তর্জাতিক মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে সক্ষম হলেও খোমেনির উত্তরসূরি আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পরম ক্ষমতা ও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধীন থাকতে হয়েছে তাঁদের।
ইরানের যেসব প্রেসিডেন্টই তাঁদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার ক্ষমতাকে কোনো না কোনোভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই চড়া রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়েছে। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন মোহাম্মদ–আলী রাজাই। তিনি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার খুবই বিশ্বস্ত একজন।
মোহাম্মদ-আলী রাজাই মাত্র এক মাস ইরানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন। ১৯৮১ সালের ২ আগস্ট তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এক মাস না পেরোতেই ৩০ আগস্ট তাঁর সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ বানোহারসহ আরও তিনজন বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন।
মোহাম্মদ-আলী রাজাই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন কাজভিন এলাকার এক দোকানি। রাজাই গণিতের শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরে তিনি বিমানবাহিনীতে কাজ করেন। শাহ আমলে তিনি দুবার কারাবন্দী হন।
মোহাম্মদ রাজাই নিঃশর্তভাবে খোমেনির অবস্থান ধরে রাখার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার এক বছর আগে রাজাই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময় তিনি তাঁর রাজনৈতিক মিত্র মেহদি বাজারগানের স্থলাভিষিক্ত হন। আয়াতুল্লাহ খোমেনির সমর্থকেরা ওই সময় মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মীকে জিম্মি করেছিলেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি তাঁকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় যে বিক্ষোভ শুরু হয়, এর জেরে পদত্যাগে বাধ্য জন মেহদি বাজারগান।
ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট আবোল হাসান বানিসাদর নতুন কাউকে প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। বাজারগানকে সরানো নিয়ে প্রেসিডেন্ট বানিসাদর ও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল এবং ধর্মীয় নেতারপন্থী ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির (আইআরপি) মধ্যে দীর্ঘ স্থবিরতা দেখা দেয়। বাজারগানকে সমর্থনের বিষয়টি বারবার পার্লামেন্টে আইআরপির কাছ থেকে বাধা পান বানিসাদর। এ কারণে দেশটির ধর্মীয় নেতা খোমেনিকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এ কারণে বানিসাদর রাজাইকে নিয়োগে বাধ্য হন। রাজাই ছিলেন আইআরপির বিশ্বস্ত সমর্থক এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ইসলামি বামপন্থার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজাই একটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ইরানি শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামিক আদর্শ আরোপে কাজ করেছেন। একই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা নিষিদ্ধ করে ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নতুন রাষ্ট্র গঠনে বিরোধীদের কেন্দ্র হয়ে উঠছে বলে তিনি এগুলো বন্ধের পক্ষে ছিলেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজাইয়ের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসার বিষয়টি হয়তো কাজ করত। তিনি হয়তো জনগণের কাজের লোক হয়ে উঠতে পারতেন। যেমনটা পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ পেরেছিলেন; কিন্তু তিনি বেশি দিন বাঁচতে পারেননি।এরভান্ড আব্রাহামিয়ান, ইতিহাসবিদ
মার্কিন জিম্মি মুক্তির বিষয়ে রাজাই আলোচনায় অংশ নেন। ১৯৮০ সালে জাতিসংঘে জিম্মি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় তিনি শাহ আমলের গোপন পুলিশ দিয়ে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। এ সময় তিনি তাঁর পায়ে নির্যাতনের চিহ্ন দেখান।
প্রেসিডেন্ট হলেন রাজাই
আইআরপি সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট বানিসাদরকে অভিশংসন করে তাঁকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে। পার্লামেন্টই তখন রাজাইকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সমর্থন দেয়। এ সময় আবারও খোমেনির আশীর্বাদ পান রাজাই।
মনসুর ফারহান জিম্মি সংকটের কারণে পদত্যাগ করার আগে জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, মোহাম্মদ রাজাই নিঃশর্তভাবে খোমেনির অবস্থান ধরে রাখার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। মনসুর আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাজারগানের খুব কমই সমালোচনা করতেন প্রেসিডেন্ট বানিসাদর। তবে বাজারগান ও বানিসাদর ‘লিবারেল’ বা উদারপন্থী বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
ফারহান বলেন, রাজাই ও তাঁর সমর্থকেরা ‘লিবারেল’ বা উদারপন্থার মতো শব্দ ব্যবহার শুরু করেন; যা অনেকটাই বিশ্বাসঘাতক বা আমেরিকাপন্থীর সমার্থক। এ অভ্যাস তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন ইরানের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি টুডেহ থেকে।
রাজাই আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ বেহেশতি ও মোহাম্মদ জাভাদ বানোহারের মতো বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতাদের প্রতি অনুগত ছিলেন, যাঁরা আইআরপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই দিনের মাথায় তিনি বানোহারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। কিন্তু বানিসাদরকে অভিশংসন নিয়ে সৃষ্ট বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এটা সবাই বুঝতে পারেন যে ইরানের প্রেসিডেন্ট একটা আলংকারিক পদ। এ ছাড়া বানোহারের মতো রাজাইয়ের নিজের কোনো অধিকার দেখিয়ে প্রভাব রাখার জায়গা ছিল না।
রাজাই যখন ইরানের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন, তখন দেশটিতে ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল। ইরাকের সঙ্গে তাদের যুদ্ধের মাত্র এক বছর পার হয়েছিল। এ ছাড়া খোমেনিপন্থী সেনারা তখনো প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিলেন। এ বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশন। তখন ইরান সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছিল এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
১৯৮১ সালের ২৮ জুন এই গোষ্ঠীর এক বোমা হামলা থেকে কোনো রকম বেঁচে গিয়েছিলন রাজাই। আইআরপি কার্যালয়ে চালানো ওই হামলায় ৭০ জন সরকারি কর্মকর্তাসহ নিহত হন আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ বেহেশতি।
পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশনের বোমা হামলার পর খোমেনি ইরানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার আধিপত্য রক্ষায় আরও বেশি মনোযোগী হন। তবে ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের চাপের মুখে প্রতিশ্রুতি ধরে রাখেন যে ধর্মীয় নেতাদের প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত নয়।
জনগণের প্রেসিডেন্ট ছিলেন না
ইতিহাসবিদ এরভান্ড আব্রাহামিয়ান বলেন, রাজাই বেহেশতি ও খোমেনির বিশ্বস্ত ছিলেন। কারণ, তিনি সত্যিই অন্য কাউকে বা নিজের কিছুর প্রতিনিধিত্ব করেননি। তিনি বেহেশতির মতো লোকদের কাছে একজন কাজের ছেলের মতোই ছিলেন।
আব্রাহামিয়ান আরও বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজাইয়ের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসার বিষয়টি হয়তো কাজ করত। তিনি হয়তো জনগণের কাজের লোক হয়ে উঠতে পারতেন। যেমনটা পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ পেরেছিলেন; কিন্তু তিনি বেশি দিন বাঁচতে পারেননি।
আব্রাহামিয়ান বলেন, বানিসাদরের মতো অনেক বিপ্লবী প্রখ্যাত পরিবার থেকে এসেছেন। ইরানের রাজনীতিতে এগুলো ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। জনগণ তাই রাজাইকে অতটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের অধীন ইরানে হোয়াইট হাউসের এইড হিসেবে কাজ করা গ্রে সিক বলেন, ইরানের নতুন সৃষ্ট শত্রুদের খুশি করতে পারেননি রাজাই। তিনি বলেন, রাজাই অনেকটাই অনভিজ্ঞ বিপ্লবী ছিলেন।
১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট তেহরানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক বোমা হামলায় রাজাই ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী বানোহার নিহত হন। এ বোমা হামলার দায় কেউ স্বীকার করেনি। কিন্তু ধারণা করা হয়, এর পেছনে পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশনের হাত ছিল।
রাজাইয়ের মৃত্যুর পর খোমেনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ধর্মীয় নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেন। তাঁর উত্তরসূরি হন আলী খামেনি।
২০০৫ সালে মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগপর্যন্ত রাজাই ছিলেন সর্বশেষ ধর্মীয় নেতা না হওয়া কোনো ব্যক্তি, যিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। আহমাদিনেজাদ নিজেও রাজাইয়ের প্রেসিডেন্টের বিষয়টিকে নিজের মডেল হিসেবে তুলে ধরেন। তবে ইসলামিক বামদের মধ্যে থাকা রাজাইয়ের পুরোনো অনেক মিত্র যেমন সাবেক শিল্পমন্ত্রী বেহজাদ নাবাভি পরে সংস্কারপন্থী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ইরানে ২০০৯ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের পর আদালত নাবাভিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আহমাদিনেজাদের প্রতিপক্ষ মির হোসেন মোসাভির পক্ষে সমর্থন দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তিনি।