বাশার আল-আসাদ: এগারোতে টিকে গেলেও চব্বিশে পালাতে হলো

সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটে ৮ ডিসেম্বরছবি: রয়টার্স

আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি টিকে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর নৃশংস স্বৈরশাসন চালিয়ে যান আরও এক যুগের বেশি সময়।

তবে আরব বসন্তের ১৩ বছরের মাথায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদের পতন ঘটে নাটকীয়ভাবে। তাঁর পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসন শুরু হয়েছিল গত শতকের সত্তরের দশকে। বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদের হাত ধরে।

বাশার আল-আসাদ টানা দুই যুগ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন
ছবি: রয়টার্স

হাফিজ আল-আসাদ ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুর পর সিরিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বাশার আল-আসাদ।

ক্ষমতার প্রথম দিকে বাশার আল-আসাদ সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। তাঁর সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় ছিল। বাবার ২৯ বছরের শাসনামলের বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা তিনি শিথিল করেন।

কিন্তু বাশার আল-আসাদ পরবর্তী সময়ে সংস্কারকের ভূমিকা থেকে বাবা হাফিজ আল-আসাদের মতোই একজন কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকে পরিণত হন।

সিরিয়ায় আরব বসন্তের ঢেউ লাগে ২০১১ সালের মার্চে। দেশটিতে শুরু হয় বাশার আল-আসাদবিরোধী বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমনে সহিংস উপায় বেছে নেন বাশার।

৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীরা সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের ঘোষণা দেয়
ছবি: এএফপি

সরকারি দমন–পীড়নের মুখে একপর্যায়ে বাশার আল-আসাদবিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেন। দেশটিতে শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।

সিরিয়াজুড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। এই লড়াইয়ে একের পর এক এলাকা বাশার আল-আসাদ সরকারের হাতছাড়া হয়।

সিরিয়া সংকটে জড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৈশ্বিক পরাশক্তি। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইরান বাশার আল–আসাদের পক্ষ নিয়ে তাঁকে রক্ষায় সামরিক শক্তি নিয়োগ করে।

লেবাননের ইরানপন্থী প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহও সক্রিয়ভাবে বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়ায়।

মূলত এই শক্তিগুলোই বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে।

বাশার আল-আসাদ সরকার হটানোর অভিযানে নেতৃত্ব দেয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)
ছবি: রয়টার্স

মিত্রদের সামরিক সহায়তা নিয়ে ২০২০ সাল নাগাদ আলেপ্পোসহ সিরিয়ার মূল শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পান বাশার আল-আসাদ।

তখন থেকে সিরিয়ার সিংহভাগ এলাকায় চলছিল বাশার আল-আসাদের শাসন। তবে দেশটিতে সংঘাত, রক্তপাত পুরোপুরি থেমে থাকেনি।

সিরিয়ায় প্রায় ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে ৬ লাখের বেশি মানুষ নিহত হন। বাস্তুচ্যুত ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ। গৃহযুদ্ধে ভয়াবহ মানবিক সংকটে পড়ে সিরিয়া। কিন্তু এদিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ না করে বাশার আল-আসাদ তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ব্যস্ত থাকেন।

এবার পতন যে কারণে

বিশ্বের নজর সিরিয়া থেকে অন্যত্র সরে যায়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। এই অভিযান শুরুর পর রাশিয়ার সামরিক অগ্রাধিকারে চলে আসে ইউক্রেন যুদ্ধ।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজা যুদ্ধ ঘিরে আঞ্চলিক উত্তেজনা বেড়ে যায়। ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে বড় ধরনের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে।

গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনের দিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের দৃষ্টি ছিল। নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়ে চমক দেন।

সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এসব বৈশ্বিক ঘটনার ডামাডোলে সিরিয়া ইস্যু হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে গত মাসের শেষ দিকে দেশটির বিদ্রোহীদের আচমকা ও বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে আবার বৈশ্বিক নজরের কেন্দ্রে চলে আসে সিরিয়া।

গত ২৭ নভেম্বর সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধারা নতুন করে, নতুন উদ্যমে বাশার আল-আসাদ সরকারবিরোধী অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)।

পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে গত ২৮ নভেম্বর মস্কোয় ছুটে যান বাশার আল-আসাদ। তিনি রাশিয়ার কাছে সামরিক সহায়তা চান। তাঁকে টিকিয়ে রাখার আবেদন জানান। কিন্তু রাশিয়ার চিন্তায় এখন ইউক্রেন। তাই মস্কো আর আগের মতো বাশার আল-আসাদকে সামরিক সহায়তা দিতে আগ্রহ দেখায়নি।

বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের মুখে বাশার আল-আসাদ পালিয়ে রাশিয়ায় যান
ছবি: রয়টার্স

দারুণ হতাশা নিয়ে দেশে ফেরেন বাশার আল-আসাদ। তবে তিনি তাঁর মস্কো সফরের ব্যর্থতা চেপে রাখেন। ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সামরিক কমান্ডারদের তিনি মিথ্যা আশার বাণী শোনান। বিদ্রোহীদের সমূলে নির্মূলের হুমকি দেন।

অভিযান শুরুর মাত্র চার দিনের মাথায় ৩০ নভেম্বর সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে নেন বিদ্রোহীরা।

বিদ্রোহী যোদ্ধাদের অভিযানের মুখে সিরিয়ার বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থান থেকে পালিয়ে যেতে থাকেন সরকারি সেনাসদস্যরা।

বাশার আল-আসাদকে টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া নামকাওয়াস্তে বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালায়। অন্যদিকে আলেপ্পো থেকে বিদ্রোহীদের দামেস্ক যাওয়া ঠেকাতে মধ্যবর্তী হামা শহরে যোদ্ধা পাঠায় হিজবুল্লাহ। কিন্তু এসব বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রা থামাতে ব্যর্থ হয়।

আরও পড়ুন
বাশার আল–আসাদের পতনের পর দামেস্কে তাঁর ছবির ওপর দিয়ে হাঁটছেন এক ব্যক্তি
ছবি: এএফপি

৫ ডিসেম্বর হামা দখল করে নেন বিদ্রোহীরা। তাঁরা দুর্বার গতিতে দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।

বিদ্রোহীদের হাতে সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসের পতন হয় ৭ ডিসেম্বর। এরপর দামেস্কের কাছের দেরা ও সুয়েইদা শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায় সরকারি বাহিনী।

৭ ডিসেম্বর বাশার আল-আসাদ তাঁর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে দেশটির শীর্ষস্থানীয় সেনা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠকে সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এই বলে নিশ্চয়তা দেন যে রুশ বাহিনী তাঁকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে।

৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ সিরিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন বাশার আল-আসাদ। এই ফোনালাপে মাঠের কঠিন পরিস্থিতির কথা বাশার আল-আসাদকে জানিয়েছিলেন আল-জালালি। জবাবে বাশার আল-আসাদ বলেছিলেন, ‘আগামীকাল, আমরা বিষয়টি দেখব।’

আরও পড়ুন

তবে বিষয়টি পরদিন আর দেখার সুযোগ হয়নি বাশার আল-আসাদের। ৮ ডিসেম্বর ভোরে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়েন বিদ্রোহী যোদ্ধারা।

বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের মুখে বাশার আল-আসাদ এদিন ভোরে একটি উড়োজাহাজে করে রাজধানী ছাড়েন। দামেস্ক থেকে বাশার আল-আসাদ যান সিরিয়ার উপকূলীয় শহর লাতাকিয়ায়।

লাতাকিয়ার রুশ বিমানঘাঁটি থেকে বাশার আল-আসাদকে মস্কোয় উড়িয়ে নেওয়া হয়। তিনি এমনভাবে দেশ ছাড়েন যে তাঁকে বহনকারী উড়োজাহাজটিকে রাডারে শনাক্ত করা পর্যন্ত যায়নি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

বিদ্রোহী যোদ্ধারা ঘোষণা দেন, জালিম শাসক বাশার আল-আসাদ পালিয়েছেন। দামেস্ক মুক্ত হয়েছে। সিরিয়া মুক্ত হয়েছে। একটি অন্ধকার যুগের সমাপ্তি হলো। একটি নতুন যুগের সূচনা হলো।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি ও আল-জাজিরা

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন