ফিলিস্তিনিদের আটকে রাখতে যে আইনের নির্বিচার ব্যবহার করছে ইসরায়েল
ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের বেথলেহেমে বাড়িতে মায়ের পাশে বসে ঘুমার্ত চোখ কচলাচ্ছিল ইয়াজেন আলহাসনাত। আগের রাতেই ইসরায়েলি বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। পাঁচ মাস আগে এক ভোরে বাড়িতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
কোনো ধরনের অভিযোগ, মামলা, প্রমাণ বা বিচার ছাড়াই ইয়াজেনকে আটক করে রাখা হয়, যাকে বলা হয় ‘প্রশাসনিক আটক’ বিধি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পুরোনো এই নিরাপত্তা বিধির অধীনে ইসরায়েল এভাবে ফিলিস্তিনিদের দিনের পর দিন কারাবন্দী করে রাখছে।
ইয়াজেন বলে, ‘তাদের (ইসরায়েল) গোপন নথি আছে। তবে তাতে কী আছে, তারা তা বলবে না।’
সম্প্রতি গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের বিনিময়ে মুক্তি পাওয়া ১৮০ ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের একজন ইয়াজেন।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছে ঠিকই, বিপরীতে বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক ধরপাকড়ও চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে বিনা অভিযোগে ও বিনা বিচারে বন্দী করা হয়েছে। এই সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ জনে গিয়ে ঠেকেছে।
ইয়াজেন যখন মুক্তি পেল, তখন তার পরিবারকে প্রকাশ্যে বিষয়টি উদ্যাপন না করতে এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলতে বলে দেওয়া হয়। একই নির্দেশনা আরও দুই কিশোরের পরিবারকেও দেওয়া হয়েছে। তাই তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসির সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু এই তিন পরিবারই বিনা অভিযোগে আটকের বিষয়টিকে সবার নজরে আনতে চায়।
ইসরায়েলের ভাষ্য, তাদের এই বিধি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
পশ্চিম তীরের মিলিটারি প্রসিকিউশনসের সাবেক পরিচালক মরিস হার্শ বিবিসিকে বলেন, বন্দীদের আপিলের সুযোগ দিয়ে এবং প্রতি ছয় মাস পরপর তাদের আটকের বিষয়টি পর্যালোচনা করার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ‘শুধু আন্তর্জাতিক আইনই মানছে না; বরং এটিকে ছাপিয়ে গেছে’।
তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, এই বিধির অত্যধিক ব্যবহার নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের শামিল। এই বিধি এত মানুষকে এভাবে আটক করার জন্য করা হয়নি। বন্দীরা ঠিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনও করতে পারে না, আপিলও নয়। কারণ, তাদের নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করার কোনো সুযোগ নেই।
ফিলিস্তিনি বন্দীদের পর্যবেক্ষণ করা ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থা হামোকডের নির্বাহী পরিচালক জেসিকা মোনটেল বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীন বিনা অভিযোগে আটক ব্যতিক্রমের মধ্যেও বিরল। তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি বর্তমানে এমন কোনো বিপদে থাকেন, যেখানে তাকে আটক করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই, তখন তাকে আটক করা যাবে। কিন্তু এটা স্পষ্ট, ইসরায়েল এটিকে সেভাবে ব্যবহার করছে না। ইসরায়েল হাজার হাজার মানুষকে বিনা অভিযোগে আটক করছে এবং এ নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন না তুলতে না পারে, সে জন্য বিনা অভিযোগে আটক বিধিকে ব্যবহার করছে।’
১৯৪৫ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা এই বিনা অভিযোগে আটকের বিধির শিকার হচ্ছে। প্রথমে ব্রিটিশ শাসনাধীনে, এরপর ইসরায়েলের দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে। ইসরায়েলে বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে এই আইনের প্রয়োগ খুব কমই দেখা গেছে। তবে শিশুসহ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের আটকে রাখার জন্য এই আইনের দেদার ব্যবহার দেখা যায়।
বিনা অপরাধে আটক ব্যক্তিদের সামরিক আদালতে শুনানি হওয়ার নিয়ম রয়েছে। তা–ও আবার ইসরায়েলি সামরিক বিচারকের সামনে। কিন্তু বন্দীদের কাছে বা তাদের আইনজীবীদের কাছে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কোনো প্রমাণ প্রকাশ করার দায়বদ্ধতা নেই। বন্দীদের ছয় মাসের শাস্তি হতে পারে। কিন্তু সামরিক আদালত সেই ছয় মাসের মেয়াদ খুশিমতো বাড়াতে পারে। এর মানে হলো প্রশাসনিক আটক ব্যক্তিদের ঠিক কত দিন এভাবে আটকে থাকতে হবে, তার কোনো হিসাব নেই।
ইয়াজেন বলে, ‘ওই অবস্থায় আসলে বন্দীদের সামনে থাকে শুধু অনিশ্চয়তা। ছয় মাস শেষ হলে বেরিয়ে যাবেন, নাকি এই মেয়াদ আরও এক বা দুই বছর ধরে বাড়তে থাকবে।’
বন্দীদের জন্য ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আপিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, সেটা জানার তাদের কোনো সুযোগ থাকে না বলে সুপ্রিম কোর্টেও তাদের বলার কিছু থাকে না। ফলে ইসরায়েলি আদালতে তাদের দণ্ডিত করার হার ৯৯ শতাংশ।
জেরুজালেম-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা আইনজীবী মাহের হান্না বলেছেন, ‘সামরিক আদালতে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। পুরো ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে একজন ফিলিস্তিনির আত্মরক্ষার উপায়কে সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমাণের বোঝা থেকে মুক্তি দেয়।’
ইয়াজেনের মা সাদিয়া বলেছেন, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের এই নীতির ব্যবহার ‘লাল, সবুজ—সব রেখা অতিক্রম করেছে’।
১৬ বছরের ওসামা মারমেশকে রাস্তা থেকে তুলে নম্বরবিহীনি একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আটকের প্রথম ৪৮ ঘণ্টা তার বাবা নাইফ ছেলে কোথায় আছে, সেই সম্পর্কেই কোনো ধারণা পাননি। ওদিকে ওসামাও বারবার জানতে চাইছিল, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ। কিন্তু প্রতিবারই তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ১৭ বছরের মুসা আলোরিদাতকে তার ঘর থেকে ভোরবেলা ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। আনার সময় ওয়ার্ডরোবে গুলি করে কাচ ভেঙে ফেলেছিল। সে কোথায় আছে, তার পরিবার তিন দিন পর্যন্ত জানত না।
ইয়াজেন, ওসামা বা মুসা যত দিন বন্দী অবস্থায় ছিল, সে সময়টা তাদের বা তাদের পরিবার বা আইনজীবী—কাউকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেখায়নি। সম্প্রতি যখন বন্দী বিনিময়ের তালিকা প্রকাশ করা হয়, সেখানে এই তিনজনের নাম ছিল। তাদের নামের সঙ্গে অভিযোগ লেখা ছিল, ‘ওই এলাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি’।
তালিকার আরেকটি সংস্করণে বলা হয়েছে, ইয়াজেন ও মুসা ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ওসামাকে যখন মুক্তি দেওয়া হয়, তখন তাকে একটি সংক্ষিপ্ত অভিযোগপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে লেখা ছিল, দুই মাস আগে ওসামা ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে একটি পাথর ছুড়েছিল।
১৯৪৫ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা এই বিনা অভিযোগে আটকের বিধির শিকার হচ্ছে। প্রথমে ব্রিটিশ শাসনাধীনে, এরপর ইসরায়েলের দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে।
সামরিক বাহিনীর আইনজীবীদের সাবেক পরিচালক মরিস হার্শ বলেন, সীমিতভাবে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত কিছু বলাটা ভুল হবে। তিনি আরও বলেন, এই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যেসব অভিযোগ পাওয়া যায় আর গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে তাদের সম্পর্কে যেসব তথ্য থাকে, এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।
মরিস বলেন, ‘আমরা দেখেছি, গুয়ানতানামোতে মার্কিনরা বিনা অভিযোগে আটকের এই নীতি ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু এটি আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত পদক্ষেপ, তাহলে শুধু ইসরায়েলকেই কেন এটি ব্যবহার করতে বাধা দেওয়া হবে। আমরাই সম্ভবত সর্বোচ্চ সন্ত্রাসী হুমকির মুখোমুখি হয়ে থাকি।’
ইয়াজেন, ওসামা ও মুসা—তিনজনই চার থেকে সাত মাস কারাগারে কাটিয়েছে। তিনজনের ভাষ্য, ৭ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত তারা যে অবস্থায় ছিল, তা তুলনামূলক ভালোই ছিল। কিন্তু সেই দিনের পর অনেক কিছু পাল্টে যায়। বিছানার চাদর, কম্বল, কাপড়চোপড় ও খাবারদাবার তাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এমনকি বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল।
সামরিক আদালতে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।
ইসরায়েলের কারা কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত করেছে, হামাস হামলা চালানোর পর তারা কারাগারে জরুরি অবস্থা বলবৎ রেখেছিল। একই সঙ্গে বন্দীদের অনেক সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়।
ইয়াজেন, ওসামা ও মুসা—তিনজনই বন্দী বিনিময়ে নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ভিত্তিতে মুক্তি পায়। তবে ইসরায়েলি কারা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, এখনো ২ হাজার ৮৭৩ ফিলিস্তিনি বিনা অভিযোগে কারাগারে আটক রয়েছেন।
মুসা বলে, তারা তিনজনই স্কুলে পড়ালেখা শেষ করতে চায়। কিন্তু আবার আটক হওয়ার অব্যাহত হুমকির মধ্যে তারা অনেকটা ‘মনস্তাত্ত্বিকভাবে আটক’ অবস্থায় রয়েছে।
ইয়াজেন বলে, ‘তারা (ইসরায়েল) আমাদের এখন একটা বড় কারাগারে ছেড়ে দিয়ে রেখেছে।’ইয়াজেনের দিকে তাকিয়ে তার মা বলেন, ‘এখানে কোনো শান্তি নেই। তারা তোমাকে যেকোনো সময় তুলে নিয়ে যেতে পারে।’